Just Another Bangladeshi

Jan 7, 20183 min

তুমি আটকে গেলে সেই ৩০ বছর বয়সেই

শীতকালে সকালে ঝুম বৃষ্টি,ভাবা যায়? তুমি থাকলে কিন্তু সময়টা বেশ যেতো, বৃষ্টি হলে তোমার পাগলামি আর আমি দু কাপ চা বানিয়ে অল্প শব্দে রবীন্দ্রনাথ ছেড়ে দিতাম।
 
আমি কিন্তু সেই দখিন দিকের বারান্দাটাতেই বসে আছি।দেশে এলাম প্রায় ২০ বছর পর,জেট লেগ কাটে নি,রাতভর জেগে আছি,ভোর বেলা ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমে গেলো।

চা বানিয়ে নিয়ে আজ প্রায় দুই যুগ পর সেই বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।চা কিন্তু দুকাপ বানিয়েছি,তোমার জন্য চিনি কম দিয়ে দুধ চা,আমার জন্য আদা দিয়ে রঙ চা,তোমার ভাসায় লাল পানসে গরম পানি আর কী

প্রিয় তানিয়া, তুমি আছো কেমন বলো তো? খুব একটা খারাপ থাকার কথা না,আমাকে ছাড়া ভালোই তো আছো মনে হয়।
 
তোমাকে চিঠি লিখছি আজ এতবছর পরে,কেনো চলে গেলে,এভাবে কেনো গেলে তার কোনো জবাব চাই নি কোনোদিন, চলে যেতে চাইলে কী আর ঠেকানো যায় বলো?

আমাদের পরিচয়ের দিনটা মনে আছে তোমার?একটা তীব্র শীতের দুপুর,সবে তোমরা ফার্স্ট ইয়ারে এসেছো,এনাটমি ডিসেকশন ক্লাস থেকে বোধহয় বের হলে তখন,আমি তখন ফোর্থ ইয়ারের লেকচার আর পরীক্ষার চাপে পিষ্ট।সেই দুপুরে কিভাবে জানি বৃষ্টি নেমে গেলো,শীতকাল, তার উপর বৃষ্টি।আমি সিগারেট খেতে লাইব্রেরী বিল্ডিং এর তিনতলার ছাদের দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম, হুট করে দেখলাম এপ্রোন পরে একটা মেয়ে শীতের মধ্যে ছাদে বৃষ্টিবিলাশ করছে।যতক্ষণ না তোমার সাথে চোখাচোখি হলো,আমি কিন্তু বেহায়ার মতন তাকিয়েই ছিলাম।😂আমি তো লজ্জাহীন ই,এটা বলতে তুমি খুব।

দেখো,কী লিখতে বসেছি,আর কী লিখে যাচ্ছি,চিঠি লিখতে গেলে উল্টাপাল্টা বলার স্বভাব আমার আর গেলো না একদম।ওই যে আমাদের সম্পর্ক টা হয়ে যাবার পর,তুমি বললে একটা চিঠি লিখতে তোমাকে।এরপর আমি এক সপ্তাহ ভেবে একটা প্রেমপত্র লিখলাম,যেটা নিয়ে আমাকে পচিয়েছো সবসময়😒

এই মাস খানেক আগে,একটা ইমার্জেন্সি অপারেশন করতে হলো,রোগীর মুখের হাড় গুলো ভেঙে গেছে এক্সিডেন্টে।এনেস্থিসিয়া দেবার আগে মেয়েটার চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ধক করে ধাক্কা লাগলো বুকে,বারবার মনে হচ্ছিলো তোমার চোখ দুটো কেউ তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে।

তুমি তো ভুলে টুলে চলে গেলে,আমি ভুলতে গিয়ে চারপাশ খুব মনে করিয়ে দিচ্ছিলো তোমার কথা।তাই সব ফেলে গাটি বোচকা নিয়ে পালালাম সাড়ে আট হাজার মাইল দূরের এক ভীনদেশে।

তোমার মনে আছে তানিয়া,তোমার ঠাণ্ডার তীব্র সমস্যা ছিলো।গরমকালেও সিলিং ফ্যান জোরে চালালে সমস্যা হতো,এসি বেশী কমায়ে দিলে সমস্যা হতো,আর আমি মোটা মানুষ,গরমে কষ্ট পেতাম।এই নিয়ে কম খুনসুটি করেছি? দেখো সেই আমি এখন এমন এক জায়গায় থাকি,বছরে ৮/৯ মাস বরফ ঢাকা শীত থাকে,ফ্যান চালানো তো দূর,আগুন জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয়।তুমি থাকলে কিন্তু বেশ হতো তানিয়া।

আচ্ছা শোনো,তুমি না বলতে আমাকে বুড়ো বুড়ো লাগে,চুল উঠে যাওয়াতে? যে কটা চুল আছে সেগুলোও পড়ে যাবে? সেই চুলগুলো কিন্তু পড়ে নি, ওজনটাও কমিয়ে আয়ত্তে নিয়ে এসেছি।তোমাকে দেয়া প্রতিটা কথা রেখেছি তানিয়া,একটা কথাও ফেলি নি আমি।

আমাদের অনেক টাকা হলে আমরা ঘুরতে যাবো,তুমি পুরো ঢাকা শহরের সব দোকানের কফি খাবে,একদিন আমরা সাজেক যাবো।কতগুলো প্ল্যান ছিলো আমাদের।তোমার কেনো তাহলে আমার সাথে থাকতে আর ইচ্ছা করলো না তানিয়া? তুমি নাকি এক কথার মানুষ,তুমিই তো বলেছিলে হাতটা ছাড়ার জন্য ধরো নি,অথচ কী অবলীলায় সেদিন সন্ধ্যায় আমার আঁকড়ে ধরা হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলে।দুহাত ভরে টাকা কামিয়েছি,পৃথিবীর সব ঘোরার জায়গা ঘুরে ফেললাম,বাংলাদেশের সাজেকে আজও গেলাম না আমি।কথা ছিলো সাজেক আমরা দুজন এক সাথে যাবো।

মশারি টানানো নিয়ে আমাদের রোজ রাতে একবার ঝগড়া হতো,তুমি মশারি ছাড়া ঘুমাবা না,মশারি তে আমার দমবন্ধ লাগে।কাল রাতে সেই মশারীর ভেতর আমাদের সেই খাটে শুয়েছিলাম।আজ দেখতে মশারীটাও মানিয়ে নিয়েছি আমি।

চিঠি বেশী বড় হয়ে যাচ্ছে? অধৈর্য লাগছে? একটু লিখি,এতবছর পর লিখছি আজ।

রাজশাহী গিয়েছিলাম এবার।চারু মামার কৃষ্ণচূড়া গাছটা ভেঙে যাবার পর একদিন ছোট্ট একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়েছিলে,মনে আছে? সেই গাছটা বিশাল বড় হয়েছিলো নাকি শুনেছিলাম,কলেজের নতুন করে ডেকোরেশনের পাল্লায় সেই গাছটা কাটা পড়েছে,তুমি দেখলে কান্না করতে,অল্পতেই অস্থির হয়ে যাওয়া তো স্বভাব ছিলো তোমার।মাঝরাতে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে কেমন ফুঁপিয়ে কাঁদতে মনে আছে? নাকি এখন আর স্বপ্ন দেখো না? থাক,মনে না থাকাই ভালো,কৃষ্ণচূড়া গাছটা না থেকে ভালোই হয়েছে।তুমি নেই সেটা যেনো বারবার বলছিলো ওই গাছের বেদীটা।

আগামী সপ্তাহে ফিরে যাবো। দেশে আর ভালো লাগছে না।কেউ নেই,কেউ তো আগেও ছিলো না।তুমি ছিলে শুধু।এখন এই না থাকার ভীড়ে বাড়ির প্রতিটা ইট কাঠ,আমাদের সেই রুমটা,হেঁটে বেড়ানো রাস্তা গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে তুমি ছিলে।

কেনো তানিয়া? আমরা না এক সাথে বুড়ো হবো বলেছিলাম,আমি একাই বুড়িয়ে গেলাম,তুমি তো আগেই পিচ্চি ছিলে,তুমি আটকে গেলে সেই ৩০ বছর বয়সেই।রাস্তাটা একটু দেখে পার হওয়া যেতো,যেতো না? গাড়িটা চলে গেলে পার হতে,আমি এসে হাত ধরে পার করাতাম।কেনো এত তাড়াহুড়ো ছিলো তোমার? খুব ভালো আছো দূরে গিয়ে?

তোমাকে নিয়ে এক জীবন কিভাবে কাটাবো এই স্বপ্ন দেখেছি,তুমি চলে গেলে কী করতে হবে তা তো বলে যাও নি।অভিমানে আজ এতগুলো বছর তোমাকে দেখতে যাই নি,তোমাকে লিখি নি।তুমি একাই বুঝি ছেড়ে থাকতে পারো?

লাঙ ক্যান্সার হয়েছে বুঝলে,তুমি কমুনিটি মেডিসিন পড়ার সময় খুব হিসেব দিতে না আমাকে,আমি যে পরিমাণ সিগারেট খাই তাতে কত বছরে আমি মরে যাবো? তুমি যাবার পর সেই হিসেব কে আগিয়ে নিতে আর কত কত সিগারেট পুড়ালাম,দেখো তাও আজ দুই যুগ তুমি ছাড়া ঠিক পার হয়ে গেলো,আমার ফুসফুসে জোর আছে বলো?

মেটাস্টাসিস করে গেছে ক্যান্সার,আর কিছুদিন।দেখা হবে, খুব অভিমান করে কথা বলবো না একদম।খুব খুব অভিমান করে থাকবো তানিয়া,এই তো আর কিছুদিন।

    5