Just Another Bangladeshi

Jan 13, 20173 min

জীবনের স্টেশনে থেমেছিলো একটাই ট্রেন

সরকারী চাকরির সুবাদে আমার বাবার বাংলাদেশটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও একধরনের ঘোরা হয়ে গেছে৷ প্রথম শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক অবধি আমার স্কুল বদলেছিলো পাঁচটা। বাবা আমার ছিমছাম মানুষ। পরিবার পরিজন নিয়ে থাকতে পছন্দ করেন তাই যেখানেই বদলি হয়েছেন সেখানেই তল্পিতল্পা সহ আমাদেরও গিয়ে হাজির হতে হয়েছে৷ নতুন জায়গায় এসে নতুনদের সাথে বন্ধুত্ব করে যখনই জীবনটা ছন্দে ফিরে আসতে শুরু করতো,তখনই বাবার আবার বদলির সময় হয়ে যেতো৷ বন্ধুগুলো ছেড়ে আমার মন দূরে যেতে চাইতো না,তবুও যেতে হতো৷

সেবার বাবার নাটোরে পোস্টিং হল। খুলনায় যে কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম সে কলেজ থেকে আবার ছাড়পত্র নিতে হল।ট্রেন নাটোর স্টেশন এসে থামলো। লোকজনের ধাক্কাধাক্কি সামলে ব্যাগপত্র নিয়ে ট্রেন থেকে নামলাম৷ ভীড়ের জন্য বোধহয় মা-বাবার নামতে দেরি হচ্ছিলো৷ ট্রেনে বসে থেকে হাত পা যেনো জমে গেছে। আমি আড়মোড়া দিয়ে বা দিকে তাকালাম৷ আমার চোখ দুটো যেনো আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আটকে গেছে হরিণী চোখ যুগলের এক ষোড়শী কন্যার দিকে৷ ধনুকের মত বাঁকা ভ্রুতে কি সব খুন হবার ইতিহাস লেখা৷ এক্ষুণি যেনো আমার খুনের ইতিহাসটাও ভেসে উঠবে৷ অসাবধান চাহনিতে মুগ্ধ হয়ে খানিক আগেই এক যুবক খুন। হ্যাঁ এটাই ভেসে উঠছে৷
 
একটা মেয়ের চোখে-ভ্রূতে বিধাতা এত ক্ষমতা দিয়েছেন?

বাবার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। বাবার সাথে প্রয়োজনীয় কথা সেরে তাকাতেই দেখি আমার খুনের ইতিহাস বহনকারী ভ্রু যুগলের ষোড়শী কন্যাটি হাওয়া। বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। যেনো রাজ্যের শূন্যতা গ্রাস করে নিচ্ছে আমায়।
 
আচ্ছা! মেয়েটি কি শাড়ি পরেছিলো নাকি সালোয়ার কামিজ?

বাবার আগে থেকে ঠিক করা ভাড়া বাসায় উঠলাম। পুরনো জীর্ণশীর্ণ একটা দোতলা বাড়ি৷ যাবতীয় কাজ সেরে ছাদে গেলাম। ছেদের রেলিং এ আচারের বয়ম তুলতে ব্যস্ত এক মেয়ে। গোধূলি লগ্নের কণে দেখা রোদে এ আমি কি দেখছি? স্টেশনের সেই চোখ? সেই মুখ?
 
.
 
.
 
- এই যে মশাই! আপনি কি জানেন এভাবে তাকিয়ে থাকলে আপনাকে হাবলুর মত লাগে?
 
- ইয়ে! মানে।
 
- হাহা! ইয়ে মানে কি?
 
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। মেয়েটি হাসতে হাসতে, আমায় আরেক দফা খুন করে ছাদ থেকে প্রস্থান নিল৷
 
অদ্ভুত আচরণ করল কেন মেয়েটি?
 
সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি ছেলেকে দেখে এভাবে হাসার অর্থ কি?
 
ও কি তবে আমায় পছন্দ করে ফেলেছে?
 
না.. না.. কি ভাবছি?
 
আচ্ছা! আমি কি হাবলুর মতো তাকিয়ে ছিলাম?
 
হবে হয়তো.. মেয়েটি হাবলু বলে হেসেছে আমায় অপমান করে, পছন্দ করে নয়৷

ঝুমুর ভাষ্যমতে আমি হাবলু,আসলেই একটা হাবলু। ভালো লাগার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেও সাহসী বুকে সামনে দাঁড়িয়ে বলা হয়নি ভালোবাসি।
 
প্রকৃতি তার খেয়াল খুশি মতোই চলে৷ প্রকৃতির খেয়ালে কখন যে ঝুমু আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে টেরই পাইনি। কিন্তু ঝুমু আমার কিসে মুগ্ধ হলো জানিনা৷

একদিন রসায়ন ২য় পত্র বইয়ের ভাঁজে নীল রঙের একটা চিরকুটে একটা লেখা দেখতে পেলাম।
 
খানিকটা উত্তেজনা বসত চোখ বুলালাম৷
 
"এই যে হাবলু! তোমার সারল্যে আমি ভেসে যাচ্ছি।
 
হৃদয় নৌকায় একটু কি ঠাঁই হবে?"
 
হাবলু সম্বোধন দেখে চিরকুটের মালকিনকে চিনতে কষ্ট হয়নি। এরপর থেকে জানালার কাছের পড়ার টেবিলটা যেনো হয়ে উঠেছিলো অদৃশ্য ডাকবাক্স।
 
বইয়ের ভাঁজে চাপা দেওয়া সম্পর্কের রসায়ন হৃদয় নৌকার বৈঠা হয়ে গিয়েছিলো৷

উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে পড়বার সুযোগ হয়৷ বাবাও বদলি হয়ে যান নেত্রকোনায়৷ আমার মন পড়ে থাকে নাটোরে আর চোখ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেটার বক্সে৷ হলুদ খাম দেখলেই মনে হয় এই বুঝি ঝুমু চলে এলো।
 
.
 
.
 
- কটা বাজে?
 
- দাঁড়াও মোবাইলটা বের করে দেখছি৷
 
- এখন ঘড়ি পরনা?
 
- নাহ... তুমি বোধহয় আর বায়ে সিঁথি করনা।
 
- সিঁথিটা মাঝেই করা হয়৷
 
আচ্ছা! স্টেশনের দেয়াল গুলিতে মনে হয় নতুন করে রঙ করা হয়েছে৷
 
- হুম! কাঁচা রঙের ঘ্রাণ। তোমার প্রিয় ঘ্রাণ।
 
- তোমার মনে আছে?
 
- সময়ের রং বদলায় কিন্তু স্মৃতি তার জায়গায় অনড়ই থাকে৷
 
- বড্ড কঠিন কথা শিখেছো। আগে তো এত কঠিন করে বলতে না৷
 
- ওই যে, সময় শিখিয়েছে৷
 
- তা, আর কি শিখিয়েছে?
 
- মনের সাথে যুদ্ধ করতে।
 
- যুদ্ধে কে জিতে? মন নাকি তুমি?
 
- মনকে জিততে দিলে তো তোমার পৃথিবী ওলট পালট হয়ে যেতো।
 
- করলে না কেন ওলট পালট? বল? আমি খুব করে চাই তুমি....
 
- ঝুমু বাদ দাও সেসব কথা।
 
- না... কেন বাদ দিব?
 
- তবে চলে গিয়েছিলে কেন?
 
- তুমি আটকাও নি কেন?

- অভিশপ্ত বেকারত্ব জেনেছে টাকাই প্রভু।
 
- একবার বলে দেখতে।
 
- অপেক্ষা কি তুমি তা জানতে না,এমন কি জানোও না৷
 
- হাবলু! একবার ঢঙ্গী বলে ডাকো না প্লিজ।
 
- নাহ!
 
- (দীর্ঘশ্বাস) বেশ! ডেকো না।

- জীবনের স্টেশনে থেমেছিলো একটাই ট্রেন।
 
সে ট্রেন ছেড়ে যাবার পর আর কোন ট্রেনকে আঁকড়ে ধরে গন্তব্যে যেতে ইচ্ছে করেনি৷ মৃত্যু পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বেঁচে থাকার জন্য অগত্যা একটা ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে হয়, তাই ফিরি৷

- তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারোনি? তাই না?
 
আমি এক গাল হেসে বললাম,
 
- পৃথিবী ভর্তি এত অনাচার, ঈশ্বর সহ্য করতে পারলে আমি পারব না?

    1