Just Another Bangladeshi

Mar 10, 20195 min

গন্ধ পেলেন?

আমার কোমরে দড়ি। দড়ির একপাশ ধরে রেখেছে একটা পুলিশ। গাঙ্গুয়া টাইপ শরীর তার। গর্জন করে বললো,
 
'ফোন দাও তোমার।'
 
আমি ফোন দিয়ে দিলাম। গাঙ্গুয়া ভীষণ মনোযোগ দিয়ে স্ক্রীন দেখলো, তারপর ব্যাটারী খুলে নাক উঁচু করে শুঁকে শুঁকে দেখলো ভেতরটা। আরডিএক্স থাকতে পারে।
 
আমি ফিসফিস করে বললাম,
 
'গন্ধ পেলেন?'
 
গাঙ্গুয়া ঝপাট করে তাকিয়ে ইংরেজীতে বললেন,
 
'নো টক।'
 
আমি চুপ মেরে বসে আছি গাড়িতে। কোমরে দড়ি লাগানোর পেছনে যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। পুলিশ ভাইদের সাথে আমার দেখা হয়েছে পনের মিনিট আগে।
 
ঘটনা ঘটিয়েছে মেশকাত। আধঘন্টা আগে ফোন দিয়ে বললো,
 
'একটা হাঁড়ি নিয়ে আয়, অমর কমপ্লেক্সের রাস্তায় যে বড় বড় গর্ত আছে, ওইগুলোতে শিরনি রাঁধবো। আমি রস আনতেছি..'
 
আমি তাজ্জব হতে গিয়েও হলাম না। শিরনি করা যায়ই তো। এতদিন কেন মাথায় আসেনি। রাস্তায় বড় বড় গর্ত। আরামসে রান্না হয়ে যাবে।
 
আমি কাঠ খুঁজলাম।
 
গ্রাম হলে সমস্যা ছিলোনা। শহরে কাঠ পাওয়ার চেয়ে ডাইনোসরের ফসিল খুঁজে পাওয়া সহজ। কাঠ খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ মনে পড়লো,
 
'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর..'
 
বাঙালির মনের সব কথা বলে গিয়েছেন রবিবাবু। আমাদের কোষে কোষে রবীন্দ্রনাথ।
 
অয়নের কথা মনে হলো। সে শ্যামনগরে থাকে। ওর আব্বার কাঠের ব্যবসা আছে।
 
রাস্তায় হাঁড়ি হাতে নেমে অয়নকে ফোনে বললাম,
 
'শিরনি খাবি?'
 
'দোস্ত, আমি একটা অনেস্ট রিলেশনশীপে আছি জেরিনের সাথে। তুই জানিস সেটা। তারপরেও অপদার্থের মতোন কি জিজ্ঞেস করিস এসব?'
 
'তুই একটা জ্বলজ্যান্ত খবিশ, বলছি শিরনি খাবি? পায়েস পায়েস হারামজাদা। শিরিন না।'
 
'ওহ, খাবো খাবো দোস্ত অবশ্যই খাবো।'
 
খাওয়া দাওয়ার জন্য সে এক পায়ের জায়গায় হাতে পায়ে চারোটায় হামাগুড়ি দিয়ে খাড়া। আমি অবিকল আমিরুল হক চৌধুরীর স্বরে বললাম,
 
'তাহলে তুই শ্যামনগর থেকে আমার জন্য কাঠ পাঠা..'
 
দশ মিনিট পার হয়ে গেল। আমি হাঁড়ি নিয়ে বসে আছি। অমর কমপ্লেক্সের সামনে, রাস্তায়। একটা বড় গর্তের উপর হাঁড়ি বসিয়েছি। দশটা গর্তের মধ্য থেকে বাছাই করা গর্ত। অয়ন এলো একটু পর, পাঁচটে বড় কাঠের টুকরো এনেছে। বেশ শুকনো, প্রচুর জ্বলবে। আশিক এলো চাউল নিয়ে। মেশকাত এলোনা।
 
ফোন দিলাম, রিসিভ করে বললো,
 
'তোমরা চিল করো দোস্ত, রস আমার হাতে...'
 
আমরা মাঝখানে শুকনো হাঁড়িতে চাউল রেখে চারোপাশে ঘিরে বসে শীতে কাঁপতে কাঁপতে চিল করছি। আশিক বললো,
 
'গর্তে আগুন ধরিয়ে দে, শীত লাগছে.. চাউল গরম হোক, রস এলে ঢেলে দেব..'
 
'দুর গাধা, আপাতত পানি লাগবে একটু'
 
আমরা হাঁড়ি রেখে পানির খোঁজে বের হলাম তিনজন। মেশকাতের উপর বিশ্বাস নেই, রস না হলে যাতে অন্ততপক্ষে সাদা ভাত হলেও হয়। পাশেই একটা বাসা।
 
কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে গেলো। আমরা তাজ্জব হলাম। রাত সাড়ে এগারোটায় এতটা ভদ্রতা আশা করিনি। টেকো মাথার আংকেল জিজ্ঞেস করলেন,
 
'কি চাই বাবারা?'
 
অয়ন ঢোক গিলে বললো,
 
'আংকেল, একটু পানি হবে?'
 
'এই সঞ্চিতা মা, একগ্লাস পানি নিয়ে আয় তো...'
 
অামি হাত উঁচু করে বললাম,
 
'আংকেল, একগ্লাস না...'
 
'এই সঞ্চিতা, তিনগ্লাস পানি নিয়ে আয় তো মা..'
 
সঞ্চিতা ট্রে'তে তিনগ্লাস পানি সাথে বিস্কুট নিয়ে আসলো পিরিচে করে। কবি নজরুল তার 'সঞ্চিতা' কাব্যগ্রন্থটি রবিবাবুকে উৎসর্গ করেছিলেন। এখানেও রবিবাবুর ছোঁয়া, আমি মুগ্ধ হলাম। আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রবীন্দ্রনাথ। সঞ্চিতার মিষ্টি চেহারা, আমার বয়েসী, চুল কাঁধ পর্যন্ত কিন্তু ভদ্রতা পা থেকে গলা অবধি। এমন ভদ্রতার সাথে আমাদের কখনোই পরিচয় ছিলোনা। এতটা আদর নিজের ঘরেও পাইনি। আমি বিস্কুটে কামড় দিয়ে চোখে জল নামালাম। নোনা জল। এই জলে কাজ হবেনা। শিরনির জন্য বিশুদ্ধ জল চাই।
 
তিনগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে হাসিমুখে বললাম,
 
'আংকেল আমাদের একমগ পানি চাই'
 
আংকেল এবার ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন। তারপর গলা উঁচু করে বললেন,
 
'এই সঞ্চিতা, মা রে.. আমার মোবাইলটা নিয়ে আয় তো..'
 
নাইন নাইন নাইন ওয়ালারা রাতে ঘুমায় না। আংকেল ফোন করার পর আমরা তড়িঘড়ি রাস্তায় নেমে আসলাম। দেখি মেশকাত একহাঁড়ি রস দুইহাতে বুকে জড়ায়ে ধরে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
 
আমাদের ফ্যাঁকাসে মুখ দেখে বললো,
 
'কি হইছে তোদের?'
 
আমরা তিনজনে অর্ধেক অর্ধেক করে পুরো ঘটনা বললাম। শুনে মেশকাত হো হো করে হাসলো। বললো,
 
'তোদের বোকা বানাইছে গাধার বাচ্চারা... ভয় দেখাইছে। আয় নবীন আয়, শীতের রাতে ভয় নাই। আগুন জ্বালা'
 
মেশকাতের ভারী সাহস। নাইন নাইন নাইন পাত্তাই দিলোনা। টকাস করে আগুন ধরিয়ে ফেললো গর্তে। বললো,
 
'এইবার জ্বাল দেব অনেকক্ষণ রস, তারপর চাউল দেবো..'
 
কি চমৎকার দৃশ্য। মাথার উপর চাঁদ। সড়কের বড় একটা গর্তে আমরা হাঁড়ি চাপিয়ে বসে আছি গোল হয়ে। একটাই কমতি ছিলো, পুলিশের টোঁ টোঁ আওয়াজ।
 
ওটাও পূর্ণ হলো। মেশকাতের যে শুধু সাহস বেশী তা না, ইন্দ্রিয়ও একটা বেশী। টোঁ টোঁ শুনেই তার হিসু পেলো। সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে একটু আড়ালে গেল।
 
তারপর ছোট্ট একটা গাড়িতে প্রায় জনা দশেক পুলিশ এসে আমাদের ঘিরে ধরলো। গাঙ্গুয়া টাইপ পুলিশটার নাম মোসাদ্দেক। তিনি বললেন,
 
'তোরা নাকি গণ্ডগোল করছিস? কোন পার্টি?'
 
আমি হাত উঁচিয়ে বললাম,
 
'আমরা নির্দলীয় স্যার, শিরনি পার্টি।'
 
'এইখানে কি করিস এত রাতে?'
 
'শিরনি করি স্যার, সব জোগাড় হয়ে গিয়েছে। আর আধাঘন্টা লাগবে। রস জ্বাল দিচ্ছি।'
 
গাঙ্গুয়া নাক চুলকে বললেন,
 
'ফারুক, হাঁড়ি চেক করো তো...'
 
ফারুক টম এন্ড জেরী কার্টুনের টমের মতোন হাঁড়ির ভেতর মুখ ঢুকিয়ে চেক করে আসলো। আমি ভয় পেলাম, মুখে হাঁড়ি আটকে গেলে তো সমস্যা। কাঠের টুকরোর দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালেন মোসাদ্দেক। চাউল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হলো।
 
'এই, তোদের নাম পরিচয় বল..'
 
আমি হাত উঁচু করে বললাম,
 
'স্যার হিসু করবো'
 
স্যার পাত্তা দিলেন না। জরুরি সময়ে মানুষ জরুরি বিষয়গুলি এড়িয়ে যায়। প্রসাব চেপে রাখা ভয়ংকর ব্যাপার। তলপেট ফেটে যেতে পারে।
 
আমি আমার হাত ধরে রাখা কনস্টেবলের কানে ফিসফিস করে বললাম,
 
'হাত ছেড়ে দিন দুই মিনিটের জন্য স্যার, যাব আর আসবো। নয়তো এপেনডিক্স ফেটে যাবে..'
 
কনস্টেবলটা আস্ত হারামজাদা। সে কি শুনলো কে জানে।'স্যার' বলে চিৎকার দিয়ে আমার হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে গুলি তাক করে বললো,
 
'স্যার আরডিএক্স আছে এর কাছে, এখুনি আমার কানে কানে বলছে- না ছাড়লে ফাটিয়ে দেবে আরডিএক্স, স্যার পজিশন..'
 
পুলিশদের মধ্যে ব্যস্ততা দেখা গেলো। কয়েকজন হাঁটু মুড়ে পজিশন নিলো গুলি করার। দেখাদেখি আমার দুই বন্ধুও হাঁটু মুড়ে পজিশন নিলো। হুট করে আসা বিপদের প্রাথমিক সময়টায় মানুষ সাময়িক আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগে। আমার দুই বন্ধুও ভুগছে।
 
আমি হাত উঁচু করে বললাম,
 
'আব্বার কসম স্যার, কিছু নাই আমার কাছে।'
 
প্রচণ্ড সতর্ক থেকে আমার পুরো শরীরে তল্লাশী চালালো কয়েকজন পুলিশ। গাঙ্গুয়া বললেন,
 
'তোর আব্বাকে হাজির করছি দাঁড়া, বাসার ঠিকানা নাম্বার দে চটপট..'
 
আমি সরলমনে হাত উঁচু করে আংকেলের বাসা দেখিয়ে দিলাম।
 
আংকেল দরজা খুলে এতগুলো পুলিশ দেখে ভড়কালেন না, বললেন,
 
'যাক, আপনারা এসেছেন। আমিই ফোন করেছিলাম আপনাদের।'
 
গাঙ্গুয়া বললেন,
 
'ভালো করেছেন। এখন একটু আসুন থানায়। আপনার ছেলেকে আমরা বাজে কিছুতে যুক্ত থাকার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করছি।'
 
আংকেল অবাক হয়ে বললেন,
 
'আমার কোনো ছেলে নেই।'
 
'সব বদমাইশ ছেলের বাবাই এইরকম বলে'
 
আংকেল হতাশ স্বরে বললেন,
 
'আমার সত্যিই কোনো ছেলে নেই'
 
'আচ্ছা ঠিকাছে নেই, তবুও আসুন আপনি।'
 
আমরা চারজন পুলিশের গাড়ির ভেতর। আমার কোমরে দড়ি। হিসু করার জন্য চারবার হাত ছুটানোর চেষ্টা করেছিলাম, তাই দড়ি। আংকেল আমার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন। আমি কাঁদোমুখে বললাম,
 
'আব্বা, আমারে মাফ করে দেন আব্বা, আমি আপনার নাম ডুবাইছি...'
 
আংকেল ঢোক গিললেন। গাঙ্গুয়া হৈ হৈ করে উঠলেন,
 
'নো ফ্যামেলি ড্রামা, নো ফ্যামেলি ড্রামা প্লিজ, থানায় বাকি কথা হবে। তোদের আরেকজন সাঙ্গ কই?'
 
মেশকাতের নাম্বার বন্ধ।
 
শত পাপ করলে এইরকম একজন বন্ধু পাওয়া যায়। আমাদের যখন চৌদ্দ শিকের ভেতর ঢুকানো হলো, তখন বাজে রাত সাড়ে বারোটা।
 
আংকেলকেও ঢুকানো হয়েছে আমাদের সাথে। তিনি বারবার আমার 'আব্বা' হতে অস্বীকার করেছেন এবং গাঙ্গুয়ার সাথে একপর্যায়ে খারাপ ব্যবহার করেছেন।
 
আংকেল গোমড়া মুখে বসে আছেন এক কোনায়। আমি শান্তনা দিয়ে বললাম,
 
'টেনশন করবেন না আব্বা, আমার একটা ছেলের মতোন দেখতে মেয়ে বন্ধু আছে। নাম বরবটি। সে ত্রিশ মিনিটের ভেতর আমাদের বের করে নিয়ে যাবে। আব্বা আপনার কসম।'
 
ঘটনা সত্য।
 
ত্রিশ মিনিটের ভেতর বরবটি এসে হাজির হলো। শিকের এপাশ থেকে হাত ঢুকিয়ে আমার কানের নিচে ঠাস ঠাস করে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,
 
'রাস্তাঘাটে আরডিএক্স নিয়ে ঘুরিস কেন?'
 
'আরডিএক্স না রে, এপেনডিক্স এপেনডিক্স'
 
'রাস্তাঘাটে এপেনডিক্স নিয়েও বা ঘুরিস কেন, এক সপ্তাহ পর পর তোর জন্য থানায় আসতেই হবে আমার! ইনি কে?'
 
আংকেলের গলার তেজ কমে গিয়েছে ততক্ষণে অনেকটা। যখন আমাদের ছেড়ে দেওয়া হলো, তখন ঘড়িতে বরাবর একটা।
 
আমরা আগের জায়গায় ফেরত আসলাম।
 
দেখি মেশকাত বসে আছে হাঁড়ি কোলে নিয়ে। গর্তে আগুন নেই। পুলিশ নিভিয়ে দিয়ে গিয়েছে। গর্তও বুজে দিয়ে গিয়েছে। মেশকাত আমাদের দেখে একছুটে এসে বললো,
 
'সব কমপ্লিট দোস্ত। হিসু, রস, হাঁড়ি, চাউল.. আগুন পাচ্ছিনা শুধু...'
 
আমি রাগলাম না। মেশকাতের উপর রাগ করা বৃথা। ওর মতোন মানুষদের জন্যই রবীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন,
 
'তুমি মোর পাও নাই পরিচয়।
 
তুমি যারে জান সে যে কেহ নয়, কেহ নয়।'
 
আমি বললাম,
 
'গর্ত কই? এটা তো বুজে দিয়েছে।'
 
'সে পাওয়া যাবে আরেকটা, বারোভাতারী রোড, প্রচুর গর্ত।'
 
আমরা এরপর দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলাম। মেশকাত আর অয়ন গর্ত খুঁজছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। আমি আর আশিক পা টিপে টিপে 'সঞ্চিতা মা'র বাসায় আসলাম। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে গেলো। আংকেলের বিধ্বস্ত চেহারা। একরাতেই ভেঙে পড়েছেন। আমি হাত পেতে আদুরে স্বরে বললাম,
 
'আব্বা, একটু আগুন হবে?'

    6