Just Another Bangladeshi

May 20, 20205 min

করোনা অতিমারি কালে

করোনা অতিমারির কালে কৃষ্ণজীরক,কালোজিরা,কোয়ারেন্টাইন; দুশ্চিন্তার সময়ে কিছু সময়ক্ষেপণ

সমগ্র বিশ্ববাসী আজ এক আতংক,বিধ্বংসের মুখে।পূর্বেও পৃথিবীবাসী অসংখ্য মহামারির সম্মুখীন হয়েছে,ঝড়েছে অসংখ্য প্রাণ।চরক সংহিতার বিমান স্থান খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে ঋষি অত্রেয় আর অগ্নিবেশের কথোপকথন হয়েছিল কাম্পিল্য নগরীতে(বর্তমান উত্তর প্রদেশের কম্পিল) ঘটে যাওয়া জৈষ্ঠ মাসের এক মহামারী নিয়ে।সে আজকের কথা নয়,খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতক অর্থাৎ আজ হতে ২৩০০ বছর আগের কথা।সারা পৃথিবী যখন আজ এমন বিপদের মুখে তখন 'বসুধৈব কুটুম্বকম' বা সমগ্র জগৎ আমাদের আত্মীয় মনে করা সর্বে ভবন্তু সুখীন কামনা করা সনাতনীরা অত্যন্ত বিমর্ষ, শোকাহত।আর তাই এ সময় কেন যেন লেখালেখি করা খুব কঠিন মনে হয়,আর একজন চিকিৎসক হিসেবে তো তা আরও শ্রমসাধ্য ব্যাপার।

তবে এরপরেও সনাতনী অনেক ভ্রাতারাই জানতে চেয়েছেন মহামারি সম্পর্কে প্রাচীন সনাতনী সভ্যতার শাস্ত্রসমূহ কি ধারণা পোষণ করত।তখনকার সমাজ,মানুষ এ নিয়ে কি ভাবত,কিভাবে মহামারী রোগ আসলে তারা তাতে প্রতিক্রিয়া দেখাত তা নিয়ে।এখানে বলাই বাহুল্য প্রাচীন শাস্ত্র কি বলত তা খোঁজার সময় আসলে এখন নয়।এ সমস্যা সমাধানে বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই আমাদের পাথেয় হওয়া উচিত।এখানে ধর্মকে আলোচনায় না এনে সামাজিকভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত এবং আনন্দের বিষয় এই যে সকল দেশের অধিকাংশ মানুষ ই এই কাজটিই করছে।কিন্তু বিশেষ একটি গোষ্ঠী সর্বদাই বিজ্ঞানের সৈনিকদের সকল আবিস্কার ঘটে যাবার পর বিবিধ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সেগুলোকে নিজেদের করে নেয়ার চেষ্টা করে।এরা আবিস্কার হবার পূর্বে এই নিয়ে কোন অবদান রাখতে পারেনা,কিন্তু আবিস্কার হবার পরেই নিজস্ব গ্রন্থের কথার অর্থকে বিকৃত করে 'আগেই লেখা ছিল' এইসব বলে নিজেদের হাস্যস্পদ করে তোলে।কালোজিরা,কোয়ারেন্টাইন এইসব ব্যাপারেও এরকম হাস্যকর সব মিথ্যা বলে এই দূর্যোগের সময়েও নিজেদের মানসিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে এরা।

সুশ্রুত সংহিতার নাম আপনারা সকলেই শুনেছেন।খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে, আজ হতে ২৬০০ বছর আগের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ঋষি সুশ্রুতের এই অমর গ্রন্থটি সমগ্র উপমহাদেশ,মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশসমূহের চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রধান উৎস ছিল।এই গ্রন্থটিতে ৭০০ ধরনের ভেষজ ওষুধের কথা বলা হয়েছে।এর মধ্যে একটি গ্রুপ হল জীরক দ্রব্য।

জীরক শব্দটির অর্থ হল যা জীরণ করতে পারে অর্থাৎ হজমে সহায়তা করতে পারে।আর এখনো আয়ুর্বেদের খ্যাতনামা এই উপাদানটি ব্যবহার করা হয় পাউডার ও তেল রূপে।রং কালো বলে একে বলা হয় কৃষ্ণজীরক,হিন্দিতে বলে কালিজিরা।জীরক বলে এটি প্রধানত পরিপাকতন্ত্রের রোগে ব্যবহার করা হয় বিশেষ করে IBS(Irritable Bowel Syndrome) নামক রোগে।এছাড়াও কফ,শ্বাসকষ্ট ও মহিলাদের মাসিকঘটিত রোগ ও ডিম্বাশয়ের PCOS নামক রোগেও এটি ব্যবহার করা হয়।

এদিকে ঋষি সুশ্রুত একে জীরক দ্রব্য বলার পর চরক সংহিতায় ঋষি চরক একে বলেন রোচক(যা স্বাদ বৃদ্ধি করে)এবং পাচক (যা হজম সহজ করে)।

আয়ুর্বেদের লঘুত্রয়ীয় অন্যতম শাস্ত্র ভবপ্রকাশ নিঘন্টু কালোজিরা নিয়ে এর ৮১-৮৫ নং শ্লোক এ বলছে-

কৃষ্ণজীরাঃ সুগন্ধশ্চ তথৈবোদ্রারসোঘনঃ...
 
জীরকত্রিতয়ং রুক্ষং কটুষ্ণ দীপনং লঘু

অর্থাৎ রস(স্বাদে) কটু, দেখতে লঘু ও রুক্ষ্ম,শক্তিতে উষ্ণ ও কর্মে দীপন বা বিপাককারী কালোজিরা।

আয়ুর্বেদে এটি বাত(বায়ু বা শ্বাস) ও শুকনো কফ এর দোষ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

তাই দুইদিনের যেসব শিশুগোষ্ঠী নিজেদেরকে কালোজিরার একমাত্র ব্র‍্যান্ড এম্বাসেডর মনে করছেন।তারা মনে করেন তাদের আগে কেউ কখনো কালোজিরার নাম ই শুনেনি।তারাই এর আবিস্কারক। তাদেরকে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা,মিশরীয় সভ্যতা,বৈদিক সভ্যতা সম্বন্ধে একটু পড়াশোনা করার আহ্বান রইল।নিজেদেরকে কতকাল আর এভাবে হাস্যকর করে তুলবেন বলুন।কালোজিরাকে অনেক প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রসমূহই একটি গুণী ঔষধি দ্রব্য হিসেবে তুলে ধরেছে।এর অনেক ভালো গুণ আছে একথা সত্য সন্দেহ নেই।কিন্তু একে সর্বরোগের মহৌষধ ভাবা হাস্যকর এবং নিতান্তই মূর্খতার পরিচায়ক।সকল রোগে গোমূত্র উটমূত্র আর কালোজিরাকেই চিকিৎসা মনে করা অন্ধত্বের পরিচায়ক।অনেকেই প্রচার করছেন Hydroxychloroquine নাকি কালোজিরা হতে এসেছে এবং এটি নাকি করোনা নিরাময় করছে।কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এটা একটা Trial Drug মাত্র যা মূলত ম্যালেরিয়ায় ব্যবহৃত হয়।এই ওষুধ ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শ অনুযায়ী কয়েকজন খেতে গিয়ে মৃত্যুবরণও করেছে ইতিমধ্যে।

এখন আমরা দেখব মহামারী নিয়ে তখনকার সমাজের কি চিন্তা ছিল।ঋষি অত্রেয় আর তাঁর শিষ্য অগ্নিবেশের কথোপকথন আমরা চরক সংহিতা হতে দেখে নিই-

অথানিয়ো জনপদধ্বংসনীয়ং বিমানং ব্যাখ্যাসামঃ।
 
ইতি হ স্মাহ ভগবানত্রেয়ঃ।
 
(চরক সংহিতা, বিমানস্থান,৩য় অধ্যায়, শ্লোক ১)

ভগবান অত্রেয় বললেন,"এখন আমরা ব্যখ্যা করব কিভাবে মহামারী জনপদ ধ্বংস্কারী রোগসমূহ বিস্তার লাভ করে।"

শিষ্য অগ্নিবেশও জিজ্ঞেস করলেন,

যুগপদসমানপ্রকৃত্যাহারদেহবলসাত্মসসত্ত্ববয়সাং মনুষ্যাণাং কস্মাদভবতীতি।।
 
(শ্লোক ৫)

"কিভাবে আলাদা বয়স,আলাদা খাদ্য,আলাদা অভ্যেস,শক্তির তারতম্য থাকা সত্ত্বেও এই মহামারি রোগ পুরো সমাজকেই আক্রান্ত করে?"

ভগবান অত্রেয় উত্তর দিলেন,
 
এবসামান্যাবতামপ্যেভিরগ্নিবেশা
 
প্রকৃত্যাদ্বিভির্ভাবৈর্মনুষ্যাণাং যৎত্নৈ বা সামান্যাস্তদ্বৈগুণ্যান।
 
সমানকালাঃ সমানলিঙ্গাশ্চ ব্যাধয়োভিনির্বর্তমানা
 
জনপদমুদধ্বংসয়ন্তি তে তু খলিমে ভাবা সামান্যা জনপদেষু ভবন্তি তদ্যথাঃ বায়ু,উদকং,দেশ,কাল,ইতি।।
 
(শ্লোক ৬)

"হে অগ্নিবেশ, মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে ঠিক কিন্তু এমন কিছু উপাদানও আছে যা সবার জন্যে এক।একই ধরনের উপসর্গের মহামারি রোগ একই ধরণের সেই উপাদানগুলোকে আক্রান্ত করে ফলে সমস্ত জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।সবার জন্য এক সেই উপাদানগুলো হল- বায়ু(সকলে একই বায়ু নিঃশ্বাসে গ্রহন করি আমরা),উদক(সবাই নির্দিষ্ট উৎস থেকে পানি গ্রহণ করি),দেশ(সবাই আমরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকি),কাল(একই সময়ে এই উপাদানগুলো আমরা শেয়ার করি)।

অর্থাৎ আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন জীবাণুবাহিত রোগসমূহের বিস্তার কিভাবে হত(যেমন বায়ুর মাধ্যমে করোনা ভাইরাস) তার একদম অত্যন্ত সুন্দর স্পষ্ট ধারণা তৎকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের ছিল।তারা জানতেন আলাদা আলাদা না থেকে একসাথে থাকার কারণেই আমরা এই ছোঁয়াচে রোগগুলোতে একে অপরের হতে আক্রান্ত হয়ে পরি।

করোনাতে আমরা কফ,সর্দি এগুলো সতর্কতার সাথে পরিস্কার করতে বলছি এবং নির্দিষ্ট স্থানে তা ত্যাগ করতে বলছি যাতে বাতাসের মাধ্যমে তা না ছড়ায়।চরক বলছেন-

কর্মপঞ্চবিধং তেষাম্ ভেষজম্ পরমুচ্যতে।
 
(শ্লোক ১৩)
 
পাঁচধরনের ভেষজ চিকিৎসা এই রোগের জন্য উত্তম বলে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

সেই পাঁচ ধরণের থেরাপির একটি হল নাস্য চিকিৎসা যাতে নাকের সব ময়লা নিরাপদে জল দিয়ে পরিস্কার করে নির্জনে নিষ্কাশন করতে হয় যাতে তা থেকে বিষ অন্যত্র না ছড়ায়।আজ করোনার মত রোগের ক্ষেত্রেও যা হাচি বা নাকের ময়লার মাধ্যমে ছড়ায় সেক্ষেত্রেও কিন্তু আমরা এই কাজ ই করি।

ছোঁয়াচে রোগে কি কি এড়িয়ে চলতে হবে তার সর্বোত্তম বর্ণনা প্রাচীনকালে ঋষি সুশ্রুত দিয়েছিলেন।
 
এইধরনের ছোঁয়াচে রোগ কিভাবে ছড়ায় আর সেই পদ্ধতিগুলো পরিত্যাগ নিয়ে সুশ্রুত সংহিতা বলছে,

প্রসঙ্গাদ্রাত্রসংস্পর্শান্নিশ্বাসাত্ সহভোজনাৎ।
 
সহশয্যাসনাদ্দাপি বস্ত্রমাল্যানুলেপনাৎ।।
 
কুষ্ঠ জ্বরশ্চ শোষশ্চ নেত্রভিষ্যন্দ এব চ।
 
ঔপসর্গিকরোগাশ্চ সংক্রামন্তি নরান্নরম্।।
 
(সুশ্রুত সংহিতা,নিদান স্থান,৫.৩৩-৩৪)

অনুবাদ- গাত্র স্পর্শ, নিঃশ্বাস,একসাথে ভোজন,একসাথে শয়ন,পাশাপাশি বসা,এক কাপড় ব্যবহার করা,এক অলংকার, ব্যবহারিক জিনিস,আসবাবপত্র ও প্রসাধনী ব্যবহারের মাধ্যমে কুষ্ঠ,জীবানুজ্বরসমূহ ও নেত্রভিষ্যন্দ(চোখ উঠা) এসব রোগ সংক্রামিত হয়(তাই এসব এড়িয়ে চলতে হবে)।

সুশ্রুত সংহিতার চিকিৎসা স্থান খণ্ডের ২৪ নং অধ্যয়ে সুচারুরূপে বর্ণিত হয়েছে কিভাবে ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রে নিয়মিত স্নান,ব্যায়াম,দাঁত মাজা, বারবার হাত ও পা ধোয়া,দই খাওয়া,বেশী বেশী জল পান করা,পরিমিত নিদ্রা এসব গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।আজ আমরা করোনা ভাইরাস ঠেকাতে ঘন ঘন হাত ধোয়া,পরিস্কার রাখা এসবকে উৎসাহিত করছি।প্রাচীন সব বিখ্যাত সভ্যতার বিজ্ঞানীগণ ই এইসব নিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন।তাদের তুলনায় একদম নব্য একটি গোষ্ঠী তাই যখন এগুলোকে নিজেদের মহিমা বলে প্রচার করে তখন সেটা সকলের হাসির খোরাক ই হয়,শ্রদ্ধার বস্তু নয়।

শেষ করার পূর্বে তিনজন শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিকে স্মরণ করবে।প্রথমেই স্মরণ করছি মহর্ষি কণ্বকে যাঁকে Microbiology বা অনুজীববিদ্যার প্রথম পথপ্রদর্শক বললে অত্যুক্তি হবেনা।তিনিই অথর্ববেদের ২.৩১,২.৩২ নং সুক্তে সর্বপ্রথম অনু-জীববিদ্যার সূচনা করেন।তিনিই অথর্ববেদের ২.৩১.২ নং মন্ত্রে ঈশ্বরপ্রদত্ত জ্ঞানে অনুজীবকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেন যা আমরা আজও করে থাকি খালি চোখে দেখা যাওয়া জীবাণু ও খালি চোখে দেখা না যাওয়া জীবাণু যাদের অণুবীক্ষণযন্ত্রের মাধ্যমে দেখতে হয়।

দৃষ্টমদৃষ্টমতৃহমথো কুরূরুমতৃহম...
 
ধ্বংস করতে হবে দৃশ্যমান(কৃমি,পোকা) ও অদৃশ্যমান(ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া) জীবাণুসমূহকে।

এরপর স্মরণ করছি বাইবেল এর Old Testament এর Book of Leviticus এর লেখক Saint কে যিনি সুশ্রুত এর পরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে প্রথম Quarantine সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেন মানবজাতিকে।

এরপর কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি Antonnie Van Leeuwenhoek কে যিনি ১৭৭৬ সালে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে অনুজীব আবিস্কার করেন।যার হাত ধরেই আধুনিক অনুজীববিদ্যা আজ এতদূর এসে পৌঁছেছে।

আসুন সবাই ধর্মের নামে কুসংস্কারকে বর্জন করি,ধর্মের নামে কুসংস্কারকে স্বিদ্ধ করার জন্য গণজমায়েত পরিত্যাগ করি।মালয়েশিয়াও এই কুসংস্কারের কারণেই বিপদে পড়েছিল।গোমূত্র,উটমূত্র দিয়ে করোনা ভাইরাসের নিরাময় হবেনা।এটা ঋষিবিজ্ঞানী চরক ও সুশ্রুত ২ হাজার বছর আগেই জানতেন,আপনি আমি তাদের চেয়ে বড় হিন্দু নই।আমরা নিজেকে অজ্ঞ প্রমাণ না করি, সবাই ঘরে থাকি,এই বিপদ থেকে পৃথিবীকে ঘুরে দাড়াতে সাহায্য করি।

    4