Just Another Bangladeshi

May 13, 20183 min

কটার্ড ডিল্যুশন

বিয়ের তিনদিনের মাথায় আমার মৃত্যু হয়। খুব আহামরি কোন রোগে ভুগেও নয়। সামান্য জ্বর ঠান্ডায়।

নতুন বউ সারাদিন তার নরম শীতল হাত আমার কপালে রেখেছে। সেই গাঢ় স্পর্ষানুভূতি এখনো টের পাচ্ছি। তবে কোন এক অদ্ভুত কারনে আমার মৃত্যুসংবাদ এখনো কাউকে জানানো হয়নি। আমি মারা গেছি রাত তিনটায়। এখন ভোর ছ’টা। তিন ঘন্টা পার হয়ে গেছে অথচ একটা মানুষকেও জানানো হল না!!

আমাদের এই ফ্ল্যাটে আমি আর লীনা আছি। তৃতীয় কোন ব্যাক্তি নেই। আগে ছিলাম আমি আর মা। মায়ের মৃত্যুর পর ছয় মাস আমি একাই ছিলাম। ছয় মাস পর আবার এই ফ্ল্যাটে দু’জন অধিবাসী হয়। সেটাও মাত্র তিনদিনের জন্য।

লীনা বড় মামার ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বড় মামার কল্যানেই লীনার সাথে আমার বিয়ে। তা না হলে এমন রূপবতী কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কল্পনা করার সাহসও আমার নেই। মামার কাছে আমি সত্যি কৃতজ্ঞ। তবে সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে লীনার সাথে আমার সংসার হল মাত্র তিনদিনের। প্রথম দিন গেল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় আর তৃতীয় দিন জ্বর-ঠান্ডায় কাবু হয়ে জীবন থেকে বিদায়। তবে দ্বিতীয় দিনটা ছিল শুধুই আমাদের। সারাটাদিন একসাথে কেটেছে। বিকেলের দিকে দুজন ছাঁদে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। আর সেই ভেজা থেকেই জ্বর ঠান্ডা।

জ্বর ঠান্ডায় কেউ মারা যায়- কখনোই শুনিনি। লীনাই বা কি ভাবছে আল্লাহ জানে! হয়ত আমার মৃত্যুটা সে হজম করতে পারছে না। সে কারনেই কাউকে জানাচ্ছে না।

মৃত্যু নিয়ে জীবিত অবস্থায় যা জেনেছি সব ভুল। আমি এখনো চিন্তা-ভাবনা করতে পারছি। তারমানে মৃত্যুর পরেই সব শেষ হয়ে যায় না। আবার মৃত্যুর সময় নাকি দেবদূত আসে। এখন পর্যন্ত কোন দেবদূতের দেখা পাইনি। মৃত্যুটা হয়ত শুধুই শক্তির এক রূপ থেকে অন্য রূপে রুপান্তর। শক্তির নিত্যতার সূত্রের মাঝেই হয়ত আমরা বন্দী।


 
পুরো চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। অথচ লীনা এখনো কাউকে কিছুই জানায়নি। ভেতরে ভেতরে আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।

আচ্ছা লীনা কি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে? সে স্বাভাবিক ভাবে রান্নাবান্নাও করছে। এরমধ্যে দু’বার আমার মৃতদেহে জোড় করে হা করিয়ে খাবার ঢুকিয়েছে। এমনকি রাতের বেলা আমার মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে ঘনিষ্ট হবার চেষ্টাও করলো।

আচ্ছা লীনা কি নেক্রোফিলিয়া আক্রান্ত? এই রোগে শুনেছি মানুষ মৃত মানুষের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। হঠাৎ তারস্বরে মোবাইলের বেজে উঠলো। আমার ফোন বাজছে। বড় মামার ফোন। লীনা শান্তভাবে ফোনটা ধরলো। অনেক কথার মাঝে এক ফাঁকে জানালো আমি নাকি ঘুমুচ্ছি!

লীনা মিথ্যা কেন বলছে? তবু আবার বড় মামার সাথে। বড় মামা বাবার মত আগলে রেখেছে আমাদের। সেই মামার সাথে কি করে মিথ্যা বলছে! আর মিথ্যা বলার রহস্যটাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

লীনার কথা শুনে বুঝতে পারছি মামা এদিকেই আসছেন। যাক, শেষ অব্দি সত্যটা সবাই জানবে।

ঘন্টা দুয়েক পরেই মামা আসলেন। সাথে কোট টাই পরা এক উজবুক টাইপের লোক। লোকটাকে আমি চিনি না। তবে লোকটাকে দেখে লীনাকে বেশ আশ্বস্ত মনে হচ্ছে। যেটা আমার কাছে বেশ অসহনীয় লাগছে। কি অদ্ভুত! মৃত মানুষও ঈর্ষাবোধ করে!!

লীনা লোকটাকে আমাদের বেডরুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। একটা নতুন অপরিচিত লোক কেন বেডরুমে ঢুকবে? মামা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মামাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

উজবুক টাইপের লোকটা আমার মৃতদেহ চেক করছে। চোখমুখ বেশ সিরিয়াস। আবার মৃতদেহকে প্রশ্ন করছে, “আপনার কি হয়েছে?”

কতবড় উজবুক। মৃতদেহ কথা বলবে কি করে!!

উজবুকটা এবার আমার মৃতদেহকে ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করছে, “আপনি মারা গেছেন কবে”?

এই পাগল উজবুকটাকে কোথা থেকে মামা ধরে এনেছে। মৃত মানুষকে জিজ্ঞেস করছে সে মারা গেছে কবে!! এই উন্মাদ পাগলাগারদ থেকে ছাড়া পেল কি করে?? আর লীনাই বা কি করে এই পাগলকে বেডরুমে ঢুকালো!! লীনাই তো উত্তরগুলো দিতে পারে। মানুষ এতো অদ্ভুত কেন!!

উজবুকটা এবার লীনার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, “উনি কটার্ড ডিল্যুশনে আক্রান্ত। এসময় এমন হয়- জীবিত মানুষ নিজেকে মৃত ভাবে। অতিমাত্রায় বিষন্নতা থেকে এর জন্ম”।

আমি পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এই বদ্ধ উন্মাদটা আমাকে জীবিত বলছে। কোন বিবেচনায় আমাকে জীবিত মনে হচ্ছে- সেটাই তো বুঝছি না। মামা বা লীনা কেন প্রতিবাদ করছে না??

উজবুকটা আবার শুরু করেছে, “আপনার মামা শ্বশুর থেকে যতটুকু শুনেছি তাতে এটা স্পষ্ট মাকে হারিয়েই সে বিষন্নতার সাগরে ডুবে যায়। যেহেতু বাবার অঢেল সম্পত্তির কারনে তাঁকে কখনোই জীবিকা নির্বাহ নিয়ে ভাবতে হয়নি, সেকারনেই মায়ের শূন্যস্থানের বিষণ্ণতায় কোন ব্যস্ততাও তাঁকে তাড়া করেনি। নিরবিচ্ছিন্ন অবসরতা তাকে বিষন্নতার জাল বিস্তারের আরো সহায়তা করেছে। আপনার মামা শ্বশুর হয়ত সেকারনেই তার বিয়ের ব্যাবস্থ করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে উনি বিষন্নতার সাগরে ডুবে গেছেন। উনার মস্তিষ্কের একটা অংশ মায়ের বিকল্প হিসেবে আপনাকে গ্রহণ করতে নারাজ। আরেকটি অংশ হয়ত জীবনসঙ্গী হিসেবে আপনাকেই চাচ্ছিল। তবে দু’য়ের দ্বন্ধ কোন একক সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেনি। তাই হয়ত কটার্ড সিনড্রোমের আগমন”।

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি এই উন্মাদটা আমাকে পাগল বানানোর পায়তারা করছে। একটা মৃতদেহ নিয়ে কি করে মানুষ এমন মিথ্যাচার করে!!

বড় মামার চোখ ভারী হয়ে আছে। যে কোন সময় পানি ঝরে পরবে। লীনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার খুব খারাপ লাগছে। এই উজবুক বদমায়েশ কেন এমন মিথ্যাচার করছে!!!

    4