Just Another Bangladeshi

Aug 12, 20184 min

এত কষ্ট করে সন্তান মানুষ করেছি কি কয়েক টুকরো মাংস খাওয়ার জন্য?

'রান্নাটা আমি নিজেই করেছি বাবা!'

ষাটোর্ধ বৃদ্ধের মুখে কথাটা শুনে আমার গলা দিয়ে খাবার নামা স্তিমিত হয়ে পড়ল। চোখ তুলে আরও একবার ভালো করে তার দিকে চাইলাম, কিন্তু অল্পস্বময়ের ব্যবধানেই চোখাচোখি হওয়ায় চোখজোড়া নামিয়ে নিতে হলো।

খতমে তারাবীহ পড়ানোর সুবাদে প্রতি রমজানেই বাসার বাইরে থাকতে হয়। এই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট একটি গ্রাম-লাকীপাড়ায় থাকতে হয়েছিল। সেই এলাকার রেওয়াজ অনুযায়ী প্রতিবছর হাফেজ সাহেবগন তাদের খাওয়াদাওয়া এলাকার সাতাশ জন মানুষের বাসায় সম্পাদন করতেন। সে বছরও এই নিয়মের বাত্যয় ঘটল নাহ।

প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও তারাবীহ শেষে খাওয়াদাওয়া করতে গেলাম। বাড়ির অবস্থা দেখে বেশ বোঝা যায় যে, দীর্ঘদিন যত্ন নেওয়া হয়নি। দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় রঙ উঠে গেছে, কিছু কিছু জায়গায় ফাটল ধরেছে, মেঝের অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না।

আমাদের বিছানার উপর বসতে দেওয়া হলো। বৃদ্ধ ব্যতিরেকে বাসায় আর কাউকে চোখে পড়ল না। খাবার থেকে শুরু করে পানি ও প্রয়োজনীয় যা যাবতীয় জিনিসপত্র সব তিনি একাই নিয়ে আসছিলেন। পরিবেশনও তিনিই করলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো পর্দার কারণে বৃদ্ধা আমাদের সামনে আসছেন না। খাবারের আয়োজনও বেশ ভালো ছিল। পোলাও, মাংস, ডাল, মাছ সহ কয়েক প্রকারের সবজি। খাওয়ার একপর্যায়ে খাবারের প্রশংসা করতে গিয়ে আমি বললাম, "চাচীর রান্নার হাত তো বেশ ভালো!"

আমার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বৃদ্ধ উপরোল্লিখিত উত্তরটি দিলেন। বৃদ্ধের কথা শুনে আমার সহকর্মী হাফেজ সাহেব সহ ইমাম মুয়াজ্জিন সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন৷ তার রান্না করার কারণ জানতে চাইলাম। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, 'বাবা, তোমার চাচীর ডিউটি আছে এখন। তাই আমাকেই আয়োজন করতে হলো!'

বৃদ্ধের মুখে আরও শুনলাম, তিনি রংপুর সরকারি মেডিকেলে কাজ করেন এবং তার স্ত্রী প্রাইম মেডিকেল কলেজে কাজ করেন। একেকদিন একেক সময় ডিউটি পড়ায় তিনি নিজেই রান্না করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন৷ অথবা দেখা যায়, চাচা বাসায় আছেন অথচ চাচী সদ্য ডিউটি শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরেই রান্নায় লেগে পড়লেন। তার করার মতো ঘরের তেমন কাজকর্ম নেই, তাই চাচীর কষ্টকে লাঘবের জন্য হলেও তিনি রান্নাটা শিখেছেন।

এই জীর্ণশীর্ণ যে ঘরটি নিয়ে তারা দিনাতিপাত করছেন, সেটা তাদের নিজের বাড়ি নয়। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে দুর্যোগকবলিত জেলা কুড়িগ্রাম শহরের অদূরেই বৃদ্ধের পিতৃনিবাস। গ্রামে তাদের সব আছে, শুধুমাত্র জীবিকার তাগিদেই শহরে পাড়ি জমানো, জীবিকার তাগিদেই গ্রামের প্রশস্ত ঘর ছেড়ে শহরের এই খুপড়িতে কালযাপন করা।

একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'ছেলেমেয়ে নেই আপনার?' প্রশ্নটা শোনামাত্র বৃদ্ধের চেহারা কালো হয়ে গেল। তার চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করে প্রশ্নকর্তা হিসেবে আমি নিজেই কিছুটা বিব্রত হয়ে গেলাম। ইতোমধ্যে খাওয়া প্রায় শেষপর্যায়ে চলে এসেছে। এমতাবস্থায় কিছু বলার জন্য দ্বিতীয়বারের মতো মুখ খুললেন বৃদ্ধ।

'একটামাত্র ছেলে আছে আমার। গ্রামে নিজের জমি ছিল কিছু৷ চাষাবাদ করে অনেক কষ্টে ছেলেকে লেখাপড়া শিখাইছি। এরপর জায়গাজমি বিক্রি করে ছেলেটাকে আর্মির চাকরী নিয়ে দেই। ছেলেটা চাকরী পাওয়ার পর আমাদের সকল কষ্ট ঘুচে যায়। প্রতি মাসে সে যে টাকা পাঠাত, সেই টাকা দিয়ে দিব্যি চলে যেত আমাদের। বছর দুয়েক বাদে ভালো ঘর দেখে ছেলেটাকে বিয়ে দিয়ে দেই।'

এতটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থামলেন বৃদ্ধ। আমরা খাওয়া শেষ করে হাত মুছতে মুছতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বৃদ্ধের কথা শুনছিলাম। বিরতির সময়টুকুতে বৃদ্ধ আমাদের জন্য পান-সুপারি নিয়ে আসলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন।

'বিয়ের পর বছরখানেক ভালোই ছিল, কিন্তু এরপরই ছেলে আমার কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করল। বউয়ের প্ররোচনায় নাকি অর্থের দাম্ভিকতায় তা উপরওয়ালাই ভালো জানেন। আগে যেখানে মাসের শুরুতেই টাকা পাঠাত, এখন সেখানে টাকা পাঠাতে পাঠাতে মাস প্রায় শেষ হয়ে আসে। ক্রমশ পাঠানো টাকার পরিমাণও হ্রাস পেতে শুরু করল। কারণ দেখাতো, আমরা বয়োবৃদ্ধ মানুষ- আমাদের এত টাকার কী প্রয়োজন! ছেলের কথায় সায় দিয়ে আমরাও হাসিমুখে মেনে নিলাম যে ঠিকই তো, আমাদের তো এত টাকার প্রয়োজন নেই!

আগে যতই ব্যস্ত বা ডিউটিতে থাকুক না কেন, প্রতিদিন রাতে ওর মায়ের সাথে, আমার সাথে কথা বলতই। এখন ধীরে ধীরে ফোন দেয়াও বন্ধ করে দেয়। সপ্তাহান্তে বা মাসে একবার ফোন দিত। সেটা যে একান্ত অনিচ্ছায়- তা তার কথাবার্তার ধরণ ও পরিধি দেখেই বেশ বোঝা যেত। সে বছর ইদেও বাড়িতে আসল না। ইদের সপ্তাহখানেক আগে ফোন করে জানাল, তার নাকি ইদে ছুটি নেই। পরে জানতে পারলাম সে তার শশুরবাড়িতে ইদ করতে গিয়েছে। আমি আর ওর মা সারাটাদিন ওর পথ চেয়ে বসে ছিলাম। ওর মা তো ইদের দিনেও কিছু মুখে তোলেনি।'

'আচ্ছা, ওনার পোস্টিং এখন কোথায়?' বৃদ্ধকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্নটি করলেন আমার সহকর্মী হাফেজ সাহেব।

'খাগড়াছড়ি' উত্তরটি দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন বৃদ্ধ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ছলছল চোখ নিয়ে তিনি আবার শুরু করলেন তার জীবনের করুণ গল্প।

'এরপর সে পুরোপুরিভাবে ফোন দেওয়া ও বাড়ি আসা বন্ধ করে দেয়। আমরা ফোন দিলেও ধরত না, বাড়ি আসতে বললে নানান অজুহাত দেখাত। আমরা দুজন তার জন্য নীরবে চোখের জল ফেলে যেতাম শুধু। এদিকে তার চাকরির জন্য জায়গাজমি সব বিক্রি করায় কালযাপন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল। অনেক সময় অনাহারে কাটাতে হতো! বাধ্য হয়ে চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে রংপুর চলে আসি। তারপর অনেক কষ্ট করে দুজনে একটা কাজ যোগাড় করে নেই। এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি আল্লাহর রহমতে।'

'তারপর উনি আর কোনো খোঁজখবর নেননি?' এতক্ষণ নীরব থাকা ইমাম সাহেব এবার মুখ খুললেন।

'পরের বৎসর কুরবানি ইদে সে বাসায় না এসে আমাদের জন্য কয়েক কেজি গরুর মাংস পাঠায় দেয়। ওর মা ও আমি একটা মাংসও ছুঁয়ে দেখিনি, সবগুলো মাংস বাড়ির পাশের পুকুরে ফেলে দিয়েছি। এত কষ্ট করে সন্তান মানুষ করেছি কি কয়েক টুকরো মাংস খাওয়ার জন্য? আমাদের প্রতি কি তার কোনো দায়িত্ব নেই? যে ছেলে আমাদের খোঁজখবর নেয় না, যে ছেলে কথা বলেনা আমাদের সাথে, যে ছেলে বাড়িতে আসার প্রয়োজন বোধ করে না, না খেয়ে মরে গেলেও তার পাঠানো খাবার মুখে তুলব না!'

এ পর্যন্ত বলেই বৃদ্ধ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার এভাবে কান্না দেখে আমার চোখের কোণেও যে কখন জল এসে জমা হয়েছে, বুঝতেই পারিনি।

বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই বলে নাকি নিজের চোখের জল লুকোতে আমি মাথা নিচু করে বের হয়ে আসলাম, তা আমার জানা নেই।

এরপর দীর্ঘদিন যাবত আমার কানে বৃদ্ধের সেই কথাটাই শুধু বেজেছে, 'এত কষ্ট করে সন্তান মানুষ করেছি কি কয়েক টুকরো মাংস খাওয়ার জন্য?'

    7