Just Another Bangladeshi

Feb 14, 20204 min

আমাদের করোনাকাল

Updated: Nov 2, 2023

Written by : Masum Billa
 

লকডাউনের একদিন আগেই সকাল বাসায় চলে এসেছে। লকডাউন দিলে প্রায় এক-দেড় মাসের মতো শহরের মানুষগুলোকে ঘরবন্ধী হয়ে থাকতে হবে। শহরের মানুষেরা শুধু দেড় মাসই নয় সারাজীবন ভরেও ঘরবন্ধী থাকতে পারবে, তবে গ্রামের মানুষের জন্য সেটা সম্ভব নয়। তাই শহরে অবস্থানকারী সমস্ত গ্রাম্য লোকেরাই গ্রামের বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করেছে। সকালও তাদের মাঝে একজন।


 
এবার বেশ হবে। আমাকে আর একা একা ঘুরতে হবে না। সকালও আছে। মানুষ যখন করোনায় ভীতিগ্রস্থ হয়ে আছে, আমাদের কাছে তখন এক উৎসবমূখর পরিবেশ বলে মনে হচ্ছে। শুধু আমাদের কাছেই নয়, প্রায়ই লোকেদের কাছেই করোনাকে একটা উৎসব বলেই মনে হচ্ছে। কোনো এলাকাতে করোনার খবর পাওয়া গেলেই গ্রামবাসীরা খুবই আগ্রহের সাথে সেই এলাকা ভ্রমণ করতে যাচ্ছে। অতঃপর করোনা রোগীর দর্শনের জন্য শয়ে শয়ে মানুষ করোনা আক্রান্ত রোগীর বাড়ি ঘেরাও করছে। গ্রামবাসীরাও খুবই আনন্দের সাথে রাস্তায় রাস্তায় বাঁশ খুটি দিয়ে বেড়া করে দিচ্ছে । বাইরের লোক যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, অতঃপর নিজেরাই দলবেধে অন্যান্য এলাকা ভ্রমণ করে আসছে। করোনা আতঙ্কে সবাই এত আনন্দ উল্লাস করছে, তবে আমরা করলেই বা সমস্যা কি?
 
সবুজ সংকীর্ণ রাস্তাটি একদম পুরোপুরি ভাবে জনশূণ্য হয়ে গেছে। যদিও‌ এমনিতেও এই রাস্তাটি জনশূণ্যই থাকে। ভেবেছিলাম একটা অটো পেয়ে যাবো। আর সেটাতে করেই সকালের কাছে যাবো। প্রায় তিন মাস ধরে ওর সাথে দেখা হয়নি, এবার যেহেতু সুযোগ পেয়েছি অতএব দেখা করে নেওয়াটাই উত্তম। সুযোগের সদ্যব্যবহার যাকে বলে।
 
প্রায় দশমিনিট পরে আমাদের অটোটা বান্দুরা এসে পৌছালো। ঘরির কাটা ধরে তেরো মিনিট দাড়িয়ে থাকার অটো পেয়েছি, আর বান্দুরা আসতে সময় লাগলো দশ মিনিট। এদিকে আমার দোস্ত সকাল ফোন দিতে দিতে আমার মোবাইলটা গরম করে ফেলেছে।
 
নয়নশ্রী ব্রিজে সকালের থাকার কথা ছিলো,কিন্তু তার কোনো দেখা পাচ্ছি না। সকাল আবারো কল দিলো,
 
ওই কুত্তা তুই কই আছা? এক ঘন্টা ধইরা দাড়াইয়া আছি!.
 
আমি তো এখন ব্রিজের উপর, কিন্তু তুই কোথায়?
 
ব্রিজের পশ্চিমে আয়, নিচ দিকে তাকা!
 
আমি ব্রিজের পশ্চিম পাশে গেলাম,তারপর রেলিং ধরে নিচে তাকাতেই দেখি সকাল তার ফর্সা দাঁতগুলো বের করে কুত্তাহাসি হাসছে। সকাল উপরে চলে আসলো। তার মুখে একটা কালো রঙের মাস্ক, অনেকক্ষন ধরে মাস্ক পড়ে থাকায় গালে দাগ ফুটে উঠেছে। আমি মাস্ক আনিনি, ভুলে গেছি!
 
কিরে তুই নিচে?
 
আরে বলিস না দোস্ত, এক ডেঙ্গুমশায় দাবার দিছিলো!
 
ডেঙ্গুমশা? একটা মশার ভয়ে তুই ব্রিজের নিচে গিয়া লুকাইছা?
 
চুপ শালা। তোরে না কইছি ইঙ্গিতে কথা বলবি! ডেঙ্গুমশা মানে পুলিশ! বুজসিছ?
 
ওহ! তো , বাড়ি টারি খাইছা নাকি? আর একটা কথা, তুই তো সেই করোনাগ্রস্থ এলাকা থেকে আসছা! তোর আবার করোনা-টরোনা হয় নাই তো?
 
সকাল মুখে হাত দিয়ে হা করে বললো!
 
তাই তো! দোস্ত, পরীক্ষা কইরা দেখতে হইবো! আমিও খুব চিন্তায় আছি!
 
সকালের থেকে ছয় ফুট দুরুত্ব বজায় রেখে হাটছি। আগে পরীক্ষা হবে, তারপর আবার একসাথে হাটবো! আমি রাস্তার কিনার দিয়ে হাটছি,আর সকাল মাঝখান দিয়ে। মাঝে মাঝে আমাকে পা পিছলে পড়ে যেতে হচ্ছে,কেননা সকাল ছয় ফুট দুরুত্ব ক্রস করতে চাইছে।
 
কাছে ঘেষতে চাইছে।
 
একদম কাছে আসবি না, দূরে গিয়া মর!
 
আমি একা মরুম না, হারামজাদা। তোরে নিয়া মরুম!
 
বাজারে ঢুকতেই বিশাল এক কাদার গর্তে পা পড়ে সকালের পা কর্দমাক্ত হয়ে গেলো। খুবই বিরক্তিকর কার্বার। সকাল পা ধোয়ার জন্য ভেতরের একটা কলপাড়ে গিয়ে ঢুকলো। তার মাস্কটা খুলে আমার হাতে দিয়ে গেলো,মুখটাও নাকি ধুতে হবে।
 
আমি এদিক-ওদিক তাকাতাকি করছিলাম। এত ভরপুর বাজারটা একদম নিরিবিলি নিস্তব্ধ হয়ে আছে। পাড়ার নেড়ি কুত্তাগুলোও রাস্তায় নামেনি,হয়তো তারাও করোনা আতঙ্কে আতঙ্কিত।
 
এই ছেলে এই! কি করছো এখানে?
 
আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। আলাদিনের চ্যারাগের জ্বিনের মতো একজন দৈত্যকার পুলিশ এসে হাজির হয়েছেন। তার চোখ রাগে একদম লাল হয়ে আছে,মুখে মাস্ক থাকায় মুখের অবস্থা বোজা যাচ্ছে না।
 
কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না! এখানে কি হচ্ছে? দাড়িয়ে আছো কেন? মুখে মাস্ক কই তোমার? মাস্ক হাতে ধরে আছো কেন? মাস্ক পড়ো!
 
আমি খুবই তীব্রতার সাথে সকালের মাস্কটা মুখে পড়ে নিলাম। পুলিশের ভয়ে করোনার পালিয়ে গেছে।পুলিশসাহেবের মুখ দেখে তেমন সুবিধার মনে হচ্ছে না। কিছু একটা বলে কাটিয়ে যেতে হবে। আমি যতটা সম্ভব মুখে একটা ইমোশোনাল ভাব আনলাম।
 
স্যার। আমার দোস্তের জন্য পানি নিতে এসেছি!
 
কি, পানি!এই ছোকরা, তোমার বাড়ি কই?
 
স্যার, এই যে নদীটা দেখছেন না? নদীর ওই পাশেই আমাগো বাড়ি!
 
তুমি ওখান থেকে এখানে পানি নিতে এসেছো! কেন তোমাদের এলাকায় কি পানি নাই!
 
জ্বি স্যার। আছে তো! পুকুর ভরা পানি আছে,জলাশয় ভরা পানি আছে,কুয়াভর্তি পানি আছে!
 
মজা হচ্ছে। বাড়ি দিয়ে তোমার ঠ্যাং ভেঙে দেবো! এত পানি থাকার পরেও এখানে পানি নিতে আসছো!
 
সামনেই সকালকে দেখা যাচ্ছে।আমি হাতের ইশারা দিয়ে তাকে লুকাতে বললাম।
 
এই এই,তুমি হাত নাড়াচ্ছো কেন? কি বললাম শুনতে পাওনি? ডাকবো ডিসিসাহেবকে,ডাকবো!
 
স্যার, ওই যে হাসপাতালটা দেখছেন না। ওইখানে আমার বন্ধু ভর্তি হয়ে আছে। পেটের ব্যাথায় ছেলেটা প্র্যাগন্যান্ট প্রায়। উপায় সোপায় না দেখে তাকে হাসপিটালে নিয়ে আসছিলাম। ছেলেটা পানি পানি বলে চেচাচ্ছে! তাই একটু পানি নিতে এসেছি!
 
তা পানি কই! কিসে করে পানি নিতে এসেছো?
 
সেটাই তো স্যার খুজছিলাম। যদি একটা বোতল টোতল পাই,তাতে করেই পানি নিয়ে যাবো। হাসপিতালে যে মগগুলো আছে তার অবস্থা দেখে করোনা ভাইরাসও ভয় পেয়ে যাবে।
 
তুমি কুড়ানো বোতলে করে বন্ধুকে পানি খাওয়াবে?
 
কি করবো স্যার। কোনো দোকানও তো খোলা নেই যে পানি কিনে নিয়ে যাবো! তা ছাড়া কুড়ানো বোতলে তো কোনো ক্ষতি নেই স্যার,মুখ বন্ধ বোতলে তো আর জামর্স ঢুকতে পারে না।
 
চলো, আমার সাথে চলো!
 
কেন স্যার? আমার কথা কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
 
আপনি তবে একবার হাসপাতালে চলুন! চোখ দিয়ে দেখলে তো বিশ্বাস করবেন!
 
পুলিশসাহেব কিছুই বললেন না। বরং সামনের দিকে হাটতে লাগলেন। আমি যে তাকে হাসপাতালের কথা বলে বসলাম, যদি সত্যিই সে সকালকে দেখতে চচায়! তখন কি করবো?
 
এই নাও। এতে পিউর বিশুদ্ধ পানি আছে। এটা নিয়ে তোমার বন্ধুকে খাওয়াও।
 
পুলিশসাহেব আমাকে তাদের গাড়ির কাছে নিয়ে এসেছেন। তিনি আমার কথায় পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করে নিয়েছেন। আমি যে মিথ্যা কথা বলছি সেটা তিনি একটুও ধরতে পারেননি। ধরতে পারলে পানির বোতলটা এগিয়ে দিতেন না,নিশ্চয়ই।
 
সকাল আর আমি একজন ডাক্তারের সামনে দাড়িয়ে আছি। তিনি চশমা চোখে দিয়ে কি সব লেখালেখি করছেন। একবারও চোখ তুলে না তাকিয়েই বললেন, এখানে একজনের ছয় হাজার লাগবে আর দুইজনের দশ।
 
ডাক্তারের কথা শুনে আমরা প্রায় থ হয়ে দাড়িয়ে আছি। দশ হাজার দিয়ে করোনা পরীক্ষার কথা শোনার চাইতে করোনায় মরণ হলেও ভালো হত।
 
দুজনেই হাসপিতালের বাইরে দাড়িয়ে আছি। সকাল কি একটা ভেবে আবারো ছুটে চললো ডাক্তারের রুমে। আবার মুহুর্তেই বেরিয়েও আসলো।
 
কি রে, আবার ডাক্তারের রুমে গেলি যে?
 
করোনা টেস্ট কইরা আইলাম।
 
মানে? এক মুহুর্তেই করোনা টেস্ট! ছয় হাজার টাকা দিছা?
 
না, একদম ফ্রি টেস্ট করেছি!
 
সকাল খোলাখুলি বলতো কি করেসিছ তুই?
 
আমি ভেতরে যাইয়া দেখি ডাক্তারসাহেব তখোনো লিখে যাচ্ছেন। আমি একটুও দেড়ি না করে তার উপরে চার পাচটা হাঁচি দিয়া দৌড় দিছি! আর আসার সময় বলে এসেছি আমি করোনা পজেটিভ! এখব আর আমার টেস্ট করতে হইবো না,ডাক্তার নিজেই টেস্ট করবো! আমি কয়েকদিন পর আইসা খবর নিয়া যামু,ডাক্তার কেমন আছে!
 
অবাক হচ্ছি সকালের কথা শুনে। কি আশর্চ একটা ছেলেরে।
 
আরে দাড়াইয়া আসিছ কেন। তাড়াতাড়ি দৌর লাগা, ডাক্তার আমারে ধরার জন্য লোক পাঠাইছে নিশ্চয়।


 

 

 

    3