Just Another Bangladeshi

Dec 5, 20176 min

অভিশপ্ত আয়না পর্ব ১

আয়নাটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুপ্তি। চমৎকার ডিম্বাকৃতি আয়না, চারপাশে লাল আর কালোর অদ্ভূত নকশা করা বর্ডার। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে আয়নার উপরে বসানো ময়ূর দুটি। ময়ূর দুটির লেজ আয়নার দুই পাশে ঝুলে রয়েছে। চোখ গুলিতে কি পাথর বসানো কে জানে, লাল রঙ এর চোখগুলো আলো না পড়লেও যেন ঝিকমিক করছে। প্রথম দৃষ্টিতেই আয়নাটির প্রেমে পড়ে গেলো সে। এরপর পুরো ঘরে এক চক্কর দিয়ে আবার সেই আয়নার সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে। মনের কল্পনায় দেখছে, আয়নাটিকে তার রুমের ওয়ার্ডরোবের পাশের দেয়ালে কি চমৎকারই না দেখাচ্ছে। আয়নার দাম যে তার নাগালের বাইরে হবে, সে নিয়ে সুপ্তির মনে কোন সন্দেহ নেই। তার স্কলারশিপের টাকা বেশীর ভাগই সে মনের আনন্দে উড়িয়েছে। সেটা নিয়ে এখন তার অনেক মন খারাপ হলো।

সে এসেছে তার মায়ের সাথে পুরান ঢাকার গলির মাঝে তস্য গলির তিনতলা এক বাড়ীতে। বাড়ীটি এত পুরনো যে যে কোন সময়ে ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়বে। সেই কোন আমলের জমিদার বাড়ি, বয়স প্রায় ৩০০ বছর।অনেক বছর বাড়িটি বন্ধ থাকার পর কে বা কারা যেন পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে অ্যান্টিক পুরনো আসবাবপত্র বিক্রি হবে। তার মার সখ অ্যান্টিক শো পিসের, একারনেই শুক্রবারের সকালে আরাম ছেড়ে তারা এখন এই পুরনো বাড়ীর বৈঠক খানায় দাঁড়ানো। সুপ্তি পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে, তৃতীয় বর্ষে। শুক্রবারে তাকে বেলা ১২টার আগে বিছানা থেকে তোলা কষ্টসাধ্য নয়, একেবার দুঃসাধ্য কাজ।

আজকে সেই কাজটি তার আম্মু, নাসরিন বেগম ওরফে নাসু, করতে সক্ষম হয়ে আব্বুর কাছ থেকে বাজীর ৩০০০ টাকা আদায় করেছে। সেই টাকা নিয়েই নাসরিন ঢু মারতে এসেছে এই পোড়ো বাড়িতে। তার আম্মুর ইতোমধ্যে একটা পানের বাটা আর একটি ফুলদানি খুবই পছন্দ হয়েছে। এখন সে দরদাম করতে ব্যস্ত সাদা চুলের বুড়োর সাথে। সেই এই বাড়িটি দেখাশোনা করে। বাড়িটির বর্তমান মালিক জন্মের পর থেকেই আমেরিকা। একবারো দেশে আসেনি। এখন সে চায় সব কিছু বিক্রি করে দেশের সাথে সম্পর্ক একেবারেই মিটিয়ে দিতে।

এক ফাঁকে সুপ্তি বাড়ির নীচতলা পুরোটাই ঘুরে এসেছে। সবকিছুরই ঝুরঝুরে দশা। দোতলার একটি ঘর কোনমতে আস্ত আছে, যেটিতে বুড়ো চৌকিদার থাকে। তিনতলায় কেউ ওঠে না প্রায় ১০০ বছর হয়ে গেছে নাকি। নীচ তলার রুমগুলি এখনো কিছুটা আস্ত আছে বটে, কিন্তু ভ্যাপসা গন্ধ আর প্রচন্ড ধূলা। এক কালের রঙিন কাঁচ গুলো অবহেলা আর পরিচ্ছন্নতার অভাবে ধূলি ধূসরিত। ঘুরতে ঘুরতে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে পড়ে সুপ্তি। বিশাল কাঠের দরজা, অতীতে হয়ত চমৎকার কাঠের কাজ করা ছিল; এখন তার উপরে কয়েক পরত ধূলার আস্তরন। সুপ্তি টানাটানি করতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেলো। রুমটি বেশী বড় নয়, মাঝারি আকৃতির।

ভিতরে ঢুকে সুপ্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। চারপাশে বিশাল বিশাল সব আলমারি, আর তাতে না হলেও হাজার দশেক বই হবে। এ বাড়ির লাইব্রেরী বোধ হয়। মাকড়সার জাল সরিয়ে সরিয়ে ঢুকতে হয়, অবস্থা এতই করুণ। ঝটপট শব্দ হচ্ছে, তার মানে ইঁদুরের সাম্রাজ্য।সাথে চামচিকাও অবশ্যই আছে। ঘরের কোনে একটা লাঠি পেয়ে সেটা নিয়েই সুপ্তি এগুতে থাকে জাল সরিয়ে।একটা আলমারি টানাটানি করে খুলতে ব্যর্থ হয়। সব মনে হয় তালা দেয়া। ঘরের এক কোনে একটা টেবিল আর ইজি চেয়ার। চেয়ারের কোন দশা নেই, কি করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তা এক বিস্ময়। টেবিলের উপরে এখনো কিছু বই ইতঃস্তত পড়ে আছে।

শত বছর আগে এই টেবিলে বসেই কেউ লিখতো, বই গুলি পড়তো – ভাবতেই সুপ্তির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। সবকিছুর উপর শত বছরের ধূলা। সুপ্তি ভাবলো তার মা এই রুমে এলেই সর্বনাশ। মার প্রবল ডাস্ট এলার্জি। বাসার সব ধূলা ঝাড়াঝাড়ি সুপ্তি আর তার বাবাকেই করতে হয়। সুপ্তি টেবিলের রাখা বইগুলোর উপর থেকে হাত দিয়েই ধূলা সরাতে থাকে। কালো মলাটের একটি মোটা বই, প্রথম পাতা খুলতেই ঝুর ঝুর করে সব খসে পড়লো। পাতা নেই বললেই চলে, যা আছে সব ইঁদুর আর পিঁপড়া মিলে ভোগে লাগিয়েছে। কিসের বই বোঝার কোন উপায় নেই। বইটির পাশে ছোট একটি ডায়েরী। সুপ্তি অবাক হয়ে দেখলো সবকিছুর ধূলার সাম্রাজ্যে ঢাকা হলেও ডায়েরীটি যথেষ্টই পরিস্কার। কেউ যেন নিয়মিত এর ধূলা ঝাড়ে। পাশেই কালির দোয়াত, তার মাঝে পাখির পালকের কলম। ধূলায় রঙ অস্পস্ট। সুপ্তি ডায়েরীটি তুলে নিল।

“এখানে কি চাই?” – গম্ভীর রাগী গলায় কেউ একজন প্রশ্ন করলো। সুপ্তি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে হাত থেকে ডায়েরী ফেলে দিলো। আতংকে তার গলা রুদ্ধ হয়ে গেলো, কোনমতে পিছনে ফিরে দেখলো বুড়ো চৌকিদার কোন ফাঁকে চলে এসেছে। এত তন্ময় হয়ে সুপ্তি সব দেখছিলো যে সে বুঝতেই পারেনি অন্য কেউ ঘরে প্রবেশ করেছে। তোতলাতে তোতলাতে সুপ্তি বললো, “এই তো, এমনি। এমনি আমি সব ঘুরে দেখছিলাম”। বুড়ো চৌকিদারের চোখ রাগে ধক ধক করে জ্বলছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “কখনো এমন কোথাও যেতে হয় না যেখানে তুমি অবাঞ্চিত। এমন কোন কিছু স্পর্শ করতে হয় না যা তোমার নয়। তোমার কৌতুহল তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই”।

সুপ্তির কাঁপুনি বেড়ে গেলো। আজকাল সে অনেক সাইকো থ্রীলারের ছবি দেখে তার বন্ধু চৈতীর পাল্লায় পড়ে। এই লোকটিও সাইকো নয় তো? “আমি…… আমি দুঃখিত। বুঝতে পারিনি”। কাঁপা কন্ঠে কথা গুলো বলেই লোকটির পাশ দিয়ে দৌড় দিলো সুপ্তি। দরজা দিয়ে বের হতে হতে সে শুনতে পেলো লোকটি কারন ছাড়াই হাসছে। বাইরে বৈঠক খানায় এসে দেখলো তার মা চার পাঁচটি প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে। যেতেই সুপ্তি ধমক খেলো। “অ্যাই পাজি মেয়ে, কোথায় ছিলি তুই? জানিস আমি কতক্ষন ধরে খুঁজছি। বাসায় যেতে হবে না? রান্না কি ভূতে করে দিয়ে যাবে?” সুপ্তি কথার উত্তর না দিয়ে দৌড়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। রাস্তায় লোকজনের মাঝে না গেলে তার কাঁপুনি কমবে না। অদ্ভুত কিছু একটা আছে এই বাড়ীতে। এক মূহুর্ত সে এখানে থাকবে না।

বুড়ো চৌকিদার ততক্ষণে ফিরে এসেছে। সুপ্তির মা তার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভাবে বললেন, “মেয়েটা আমার বড় পাগলী হয়েছে। তাহলে আজ আসি?” “জ্বী জ্বী। তবে কি আমি চায়ের সেটটি আপনার জন্য রাখবো? একেবারে খাঁটি পুরনো জিনিস কিন্তু, ১৫০ বছরের কম বয়স না”। সুপ্তির মা দুঃখের সাথে মাথা নাড়লেন, “যে দাম বলছেন, তাতে কোন ভাবেই সম্ভব না”। “আরেকটু না হয় কমালাম, আপনি এত জিনিস নিলেন”। সুপ্তির মা কিছুক্ষন ভেবে বললেন, “আপনি দিন ১৫ যদি রাখতে পারেন তবে ভালো হয়, এর পর আমি এসে নিয়ে যাবো”। “ভালো খদ্দের না পেলে রাখবো। আপনি খবর নিয়েন”।

প্রথম দুই তিন দিন সুপ্তির রাতে একা ঘুমুতে একটু ভয় ভয় করছিলো; কিন্তু তার ছোট বোন হচ্ছে পাজির পা ঝাড়া। কি ভেবে যে আব্বু তার নাম সুকন্যা রেখেছে সে আল্লাহ মালুম। একবার যদি শোনে যে সুপ্তির রাতে ঘুমুতে ভয় করছে, ফোন করে করে সবার কাছে খবর পৌঁছে দেবে। তাই সে যে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাচ্ছে, তা কাউকে জানতে দিলো না। দিন তিনেক পরেই সব আগের মত। অ্যাসাইনমেন্ট আর পরীক্ষার ধাক্কায় সুপ্তির জীবন চলতে লাগলো আগের ধারায়।

২৪শে এপ্রিল সুপ্তির জন্মদিন। ২৩শে এপ্রিল রাতে সে খুবই আনন্দ নিয়ে জেগে থাকে। প্রতিবারই জন্মদিনে রাত ১২টা এক মিনিটে সে বেশ কিছু উপহার পায়। তার মাঝে কিছু উপহার গৎবাঁধা। তার ভালো মানুষ বাবা একটা খামে শুভ জন্মদিন লিখে কিছু টাকা দেবে, যেটাতে সে বন্ধুদের খাওয়ায়। তার পাজি বোন একটা কার্ডে হ্যাপী বার্থডে লিখেই খালাস। ছোট খালা উপহার আগেই পাঠিয়ে রাখে। প্রতি বছরই সে একটা করে জামা পায়। পাশের বাসার নীনা আন্টির কেক পুরো বিল্ডিং এ হিট। নীনা আন্টি একটা কেক বানিয়ে আনে। গত বছর নীনা আন্টির ৪ বছরের ছেলে কৌশিক একটা ললিপপ দিয়েছিল। যেটা দেয়ার আগে আবার সে খানিকক্ষন খেয়েছে।

এবছর কি করবে কে জানে! তবে তার আম্মুর দেয়া উপহার সবসময়ই ব্যতিক্রম। কোনবারের সাথে কোন বারের টা মিল থাকে না। এই তো দুই বছর আগে সে পেয়েছিলো রবীন্দ্র রচনাবলীর সেট, গত বছর আম্মু তার জন্য কিনে এনেছিল মুক্তার চমৎকার একটা সেট। পার্টিতে সে প্রায়ই সেটা পড়ে। এবছর কি পাবে তা নিয়ে সে খুবই উত্তেজিত। শুয়ে শুয়ে সে ঘুমের ভান করতে লাগলো। ১২টা ১ বাজার সাথে সাথে সবাই হ্যাপী বার্থডে টু সুপ্তি বলতে বলতে রুমে ঢুকে পড়লো। সুপ্তি ভান করলো যে সে একেবারে আকাশ থেকে পড়েছে। ডাইনিং রুমের টেবিলের উপরে নীনা আন্টির কেক রাখা। চারপাশে মোমবাতি সাজানো।মোবাইলে টানা ভাইব্রেশন হচ্ছে, মেসেজ আসার জন্য।

আনন্দে সুপ্তির চোখে জল এলো। কেক কাটা পর্ব শেষ করেই সবাই ঘুমানোর জন্য দে ছুট। আম্মু এসে সুপ্তির কপালে চুমু দিয়ে তার উপহারটি বিছানায় রেখে গেলো। সবাই চলে গেলে পরে গভীর রাতে সুপ্তি তার উপহারগুলো খুলতে বসলো। তার বোনের কার্ডটির মাঝে এবার বান্দরের ছবি। দাঁত বের করে বান্দরটি হ্যাপী বার্থডে জানাচ্ছে।সুখের বিষয় এবার কৌশিক কোন উপহার ছাড়াই এসেছে। ছোট খালার জামাটিও মন্দ না। আব্বুর দেয়া টাকা গুলি ব্যাগে ভরে সুপ্তি আগ্রহ ভরে আম্মুর দেয়া উপহার খুললো।

উপহার খুলে সুপ্তি খানিকক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এরপর আবার নতুন করে চোখে জল আসা শুরু হলো। যে আয়নাটি দেখে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো ওই পোড়ো বাড়িতে, আয়নাটি তার আম্মু তার জন্য নিয়ে এসেছে। মা দের চোখে কি কিছুই এড়ায় না? সুপ্তি উঠে তার ওয়ার্ডরোবের পাশের দেয়াল থেকে ক্যালেন্ডারটি সরিয়ে আয়নাটা লাগায়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সে আবার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে। চারপাশের বর্ডারে কি সূক্ষ্ণ কারুকাজ। কাঠের মাঝে লাল আর কালো রঙ করা।

উপরের ময়ূরের লেজ দুইটি কি দিয়ে বানানো যে এত বছর পরেও এতটুকু রঙ নষ্ট হয়নি? আর চোখ গুলি কি রুবী? সুপ্তির চেহারা তার নিজের কাছে বিশেষ সুবিধার কখনোই মনে হয় না। কিন্তু এখন সে নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। আয়নায় কি সুন্দরই না তাকে লাগছে। একটা লাল টিপ এনে কপালে পড়লো। রূপকথার রাজকন্যা যেন। আনন্দ দিয়ে সুপ্তি ঘুমাতে গেলো। কিন্তু ঘুম কেন যেন খুব ছাড়া ছাড়া হলো। শেষ রাতের দিকে তার ঘুমের মাঝেই মনে হতে লাগলো কেউ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

    0