Just Another Bangladeshi

Feb 10, 20175 min

পাপ

সিলিং ফ‍্যানে ঝুলছে শিউলি। আমার জমজ বোন, আমার ঝগরাটে বোন, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, শিউলি। শিউলির চাঁদ সুন্দর মুখটা কেমন শ‍্যাম বর্ণের হয়ে গেছে। চোখ দুটো রক্ত জবার মতো লাল হয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বুকের কাছে সব সময় আগলে রাখা ওড়নাটা এখন গলায় পেঁচানো। গলার ফাঁস দেয়া জায়গাটা কেটে গিয়ে ভেতরের লাল মাংস দেখা যাচ্ছে। তাকে দেখে আমার চিৎকার দেয়ার কথা, কেঁদে কেটে সারা বাড়ি এক করার কথা। কিন্তু আমি এসবের কিছুই করছি না। শুধু দাঁড়িয়ে আছি দরজার কাছে একটা বোকাসোকা ছেলের মতন। আমার চোখ থেকে টপটপ করে জলের ফোটা ঝরছে। আমি জলের ফোঁটা গোনায় মনোযোগ দিতে চাইলাম।

এক

দুই

তিন

আর গোনা যাচ্ছে না। কিছুতেই গোনা যাচ্ছে না। আমার শক্ত পোক্ত শরীরটা পান পাতার মতো কাঁপছে। যেন আমি হঠাৎ করে খুব দূর্বল হয়ে উঠেছি। যেন আমার পায়ের নিচটা একেবারে খালি হয়ে গেছে। যেন আরেকটু খানি বাতাস এলেই আমি মুখ থুবড়ে পড়বো।আম্মা এখনও তার ঘরে। নামাজ পড়ছেন। তিনি রোজ নামাজ পড়ে কোরান তিলাওয়াত করেন। তারপর লম্বা দোয়া।তাই তিনি বাড়িতে ঘটে যাওয়া এতো বড় কান্ডের কথা জানতে পারছেন না। আমার অভ‍্যাস রোজ করে সকালে শিউলির দরজায় এসে টোকা দেয়া।টোকা দিলেই সে দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে। তারপর আমরা পুকুর পাড়ে শিউলি গাছের তলায় সাদা মুক্তোর মতো জ্বলতে থাকা শিউলি ফুল কুঁড়াতে যাই। কিন্তু আজ এসে দরজায় টোকা দিতেই শিউলি এলো না দরজা খুলতে।দরজাটা খুললো এমনি এমনি। তারপর দেখি এই কান্ড। শিউলি বোধহয় ইচ্ছে করেই দরজাটা খোলা রেখেছে। মৃত্যুর আগেও ঠিক তার বোধ ছিল।সে জানতো দরজা বন্ধ করে আত্মহত্যা করলে ও পাশ থেকে দরজাটা স্বাভাবিক ভাবে খোলা যাবে না।ভাঙতে হবে। আমাদের মতো গরীব পরিবারের একটা দরজা ভাঙলে নতুন করে এটা ঠিক করা খুব কষ্টের। নিজের জীবন বিনাশ করে দেয়া বোন আমার ঘরের একটা দ্ধারের বিনাশ সহ‍্য করতে পারেনি। এমন লক্ষ্মী একটা মেয়ের জন্য আমার চিৎকার করে কাঁদা উচিত। গগণবিদারী আর্তনাদে খোদা কে জানিয়ে দেয়া উচিত ,'কী করলে এটা খোদা?' কিন্তু আমি এসবের কিছুই করছি না।করতে পারছিও না। আমার ঠোঁট দুটো হঠাৎ একসাথে সেঁটে গেছে। আমি কিছুতেই দু ঠোঁট আলাদা করতে পারছি না। এমন কাজ কেন করলো শিউলি তা আমার খুব ভালো জানা আছে।জানা আছে বলেই প্রমাণ খুঁজতে এখানে ওখানে চিঠিপত্র,কাগজ টাগজ খুঁজছি না। আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগেই মৃত্যুর অসুখ তুলে দিলো আম্মা শিউলির কাঁধে। শিউলি খুব করে প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু আম্মা পারেননি। তিন ছিলেন সমাজের নষ্ট কানুনে আবদ্ধ।

সেদিন রাতে ঘুমানোর সময় আম্মা শিউলির গায়ে হাত তুলেছেন। কাঁধ সমান মেয়ের গায়ে মায়ের হাত তুলা কী উচিৎ? বিষয়টা নিয়ে আমি ভাবলাম। আম্মার কাছে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। কিন্তু এখন এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। আমি দরজার পাশে কান পেতে আম্মার ফিসফিসে গলা শুনেছি। শিউলিকে আম্মা বলছেন,'জামাই কী তোর বুকে ইচ্ছে করেই হাত দিছে না এমনে এমনেই লাগছে ?'

শিউলির গলা শোনা যাচ্ছে না। এবার বোধহয় আম্মা তার গালে চড় মেরেছেন। দরজার ওপাশ থেকে যে শব্দটা আমি পেয়েছি এটা ঠিক চড়ের।মার কাছ থেকে অগুণিত বার এই জিনিস আমি উপহার হিসেবে পেয়েছি তাই আমি এর সাথে খুব পরিচিত।দূর থেকে শব্দ শুনলেই বুঝে ফেলতে পারি এটা চড়। আম্মা ফের জিজ্ঞেস করলেন শিউলিকে।'বল,জামাই কী তোর বুকে ইচ্ছে করে হাত দিছে?'

শিউলি এবার কেঁদে ফেলেছে।অতবড় মেয়ে কেমন ভে ভে করে কাঁদছে। আমার সত‍্যি হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু পরবর্তী অংশ শুনে হাসিটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল। শিউলি তার ভেজা গলায় মাকে বললো,'ইচ্ছে করেই দিছে। আমার জামার ভেতর দিয়ে----'

আম্মা ধমক দিয়ে শিউলিকে থামিয়ে দিলেন। 'চুপ চুপ। এক্কেবারে চুপ।এই কথা যেন আর কেউ না জানে।যা হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়।'

কিন্তু শিউলি হাত মুখ ধুতে গেল না।সে আম্মার কাছে বললো,'আমি আর আপাদের বাড়ি যেতে পারবো না। তুমি তাকে সাফ জানিয়ে দাও।'

'কী সাফ জানাইয়া দিবো আমি। আমার মাইয়ার পেট লইয়া সে কাম কাজ কেমনে করবো?আর মাত্র কয়দিন ই তো।একটু সাবধানে থাকলে আর কিছু হয়তো না।'

'হোক না হোক আমি আর যেতে পারবো না।'কথাটি বলে বোধহয় শিউলি বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে যেতে চেয়েছিল। ঠিক তখন আম্মা তাকে ধাক্কা দেয়। ধাক্কা সামলাতে না পেরে শিউলি ঘরের মেঝেতে পরে যায়।না আমি নিজের চোখে দেখিনি। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অনুমান করছি। শিউলি এখন আর কাঁদলো না।তার গলা ঝাঁঝালো।সে সেই ঝাঁঝালো গলায় বললো,'তোমার কী মতলব আম্মা শুনি? নিজের মাইয়ারে নষ্টা বানাবার খুব শখ না? মানুষের খাদ্য বানাবার খুব ইচ্ছে?'

আম্মার মাথা বোধহয় আগুন হয়ে গেছে শিউলির কথা শুনে। তারপরের প্রতিক্রিয়া শুনে এই অনুমান করেছি আমি। শিউলির গায়ে যে কিলঘুষি দিয়েছেন আম্মা তা আমি স্পষ্ট শুনেছি। একবার আমার মনে হয়েছে এই কিলঘুষি গুলো বুঝি কেউ আমার গায়েই দিচ্ছে। আরেকবার মনে হলো,না আমার গায়ে একা নয়। এই কিলঘুষি গুলো সমাজের অন্ধকারে ধুঁকে মরতে থাকা কোন এক বিদ্রোহী সত‍্য আমার মাকে এবং আমাকে দিচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো তখন চিৎকার করে মাকে বলতে,'আম্মা, কেন নিজের মেয়ের উপর তুমি অবিচার করছো?'

কিন্তু কথাটা বলা গেল না। কারণ ততক্ষণে আমি জেনে গেছি আমার থেকে শিউলির প্রতি আম্মার দরদ শত কোটি গুণ বেশি। কিন্তু তিনি যে সমাজের এক অন্ধ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তিনি যে এ নিয়ম ভেঙে বলতে পারেন না,'তুমি দোষী। তোমাকে আমি শাস্তি দিবো।'

আহারে! আমার খুব কষ্ট লাগছে আজ।সারা রাত বিছানায় এ পাশ ও পাশ করেও কিছুতেই আমার চোখে ঘুম এলো না।

পরদিন সকাল সকাল আম্মা শিউলিকে তুলে দিলেন অটোতে। বললেন,'এই কটা দিনই তো মা,তোর তো এখন ছুটি। লম্বা ছুটি।এই কটা দিন বোনটাকে সাহায্য করে আয়।তোর মঙ্গল হবে।'

বোন আমার এমন মঙ্গল চায়নি। যাওয়ার সময় তার চোখে কিছু একটা দেখেছিলাম আমি। নীল নীল কিছু একটা। নীল রং কষ্টের। নীল রং ব‍্যার্থতার। নীল রং অভিমানেরও।এর কোন একটা ছিল তার চোখে। তারপর বোনের বাড়ি থেকে চার -পাঁচদিন পর হঠাৎ ফিরে আসাটাও বেশ অবাক হওয়ার,চিন্তারও। তাহলে কী------

গতরাতে আম্মাকেও বড় চুপচাপ দেখেছি। তার মুখ দেখে মনে হয়েছে খুব চিন্তিত।ফিরে আসা শিউলি রাতে কিছু খায়নি।ওর পাশে গিয়ে একবার বসেছিলাম আমি, কোন কথা বলেনি। আমি তাকে হাসানোর কত চেষ্টা করলাম,কত মজার মজার কথা বললাম কিন্তু এক বারের জন্যও সে হাসেনি।শেষ পর্যন্ত উঠে আসার সময় তাকে বললাম,'শিউলি ফুল কুড়োতে যাবি না ভোরে?'

ও উপর থেকে নিচে মাথা নামালো। আমি ঝটপট তার ঘর থেকে চলে আসলাম। এসে বিছানায় শুয়ে খুব কষ্ট হলো ঘুমাতে আমার।বার বার কেবল চোখের সামনে ভেসে উঠছিল দোলাভাইয়ের হাসিভরা মুখ।তার হাসি এমনিতে খুব সুন্দর।কিন্তু এই সুন্দর হাসিটা আমার চোখে কেমন ভয়ংকর লাগছিল। আমার কেবল মনে হতে লাগলো শিউলির কোন একটা ক্ষতি করেই ফেলেছে দোলাভাই।

'

ধর্মকর্ম শেষ করে আম্মা এসেছেন শিউলির ঘরে। এসে দেখেন আমি মূর্তির মতো মাটিতে পা পুঁতে দাঁড়িয়ে আছি আর আমার সামনে আরেকটি মূর্তি।মূর্তিটা সিলিং ফ‍্যানে ঝুলছে।জানলা দিয়ে বাহির থেকে দখিন মুখি বাতাস এসে নাড়িয়ে দিচ্ছে ঝুলে থাকা সেই মূর্তি।দৃশ‍্যটা দেখে প্রথম বেলায় আম্মা চিৎকার দিতে পারলেন না। তিনি শুধু অস্পষ্ট এবং বিকৃত গোঙানির মতো করে আওয়াজ করলেন। তারপর খাটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে শিউলির পায়ে চুমু খেতে খেতে চিৎকার

করে বললেন,'মা আমার কী করলি এটা,কী সর্বনাশ করলি!সব দোষ আমার রে মা,সব দোষ আমার। তুই যাইতে চাস নাই কিন্তুক আমি তোরে জোর-জবরদস্তি কইরা পাঠাইছি। আমি তোরে মৃত্যুর মুখে তুইলা দিছি রে মা, রাক্ষসের মুখে তুইলা দিছি।'

আম্মা খাটের উপর থেকে হঠাৎ কী মনে করে যেন নেমে এলেন। তারপর এখানে ওখানে বঁটি খানি খুঁজতে লাগলেন আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন,'আমিও বাঁচুম না রে মা আমিও বাঁচুম না। নিজের মাইয়ারে বধ কইরা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নাই আমার!'

মার এমন ভয়ঙ্কর কান্ড দেখে আমার কষ্ট পাওয়ার কথা। তার হাত ধরে ফিরিয়ে শান্তনা দেয়ার কথা। কিন্তু আমি এসবের কিছুই করছি না। আমি হাসছি। হেসে মনে মনে বলছি,'মারে, তোমার এই একটা জীবন বধ কী পারবে শিউলির প্রতিদান দিতে? পারবে আর সকল শিউলি দের বাঁচাতে?পারবে না মা পারবে না।এই সমাজের আসল পাপিদের বিরুদ্ধে মুখ না খুলে, প্রতিবাদ না করে এভাবে নিজের ধ্বংস করাও যে পাপ।এই পাপ কোনদিন তোমার সমাজ কিংবা তোমার প্রভু ক্ষমা করে দিবেন না। কোনদিন না।'

    0